পৃষ্ঠাসমূহ

সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

।। জীবন ক্যানভাসে আঁকা গল্প ।। ১

মুক্তিযুদ্ধের একটা মর্মান্তিক কাহিনী। 

লিখেছেন saad ahmed (dmc) 

সেদিনের আকাশ ছিল ঘন মেঘে ঢাকা। কালো, পাংশুটে মেঘমালা ঈশান কোনে জমে ছিল।
দিন শেষে ঝুপ করে রাতের কালো আঁধারের চাদরে ঢেকে গেল চারপাশ।
ছিলনা পাখির কলরব, ঝি ঝি পোকার অবিশ্রান্ত গুঞ্জন।
১৯৭১ সালের কোন এক রাত।
সালেহা বেগম রান্না ঘরে বসে গরুর মাংস কাটছিলেন। তার স্বামী আতাউর রাহমান আজ রাতে খিচুরির সাথে ভুনা গরুর মাংস খেতে চেয়েছেন। সারাদিন ডাক্তারি করে রাতে তিনি ফিরবেন।
সালেহা বেগমের দুই সন্তান। মেয়েটার বয়স ১০ বছর। খুব ই আহ্লাদী। অদ্ভুত রকমের আব্দার তার। যেমন সেদিন সে বলছিল, “মা ! ভিক্টোরিয়া পার্কের ফোয়ারাতে নাকি লাল পানি বের হয়। আমাকে একটা লাল পানির ফোয়ারা বানিয়ে দিবে? আমি সারাদিন দেখব !”
“তোর বাবাকে বল ! বাড়ির সামনের জায়গায় বানিয়ে দিতে বলিস”।
মেয়েটা উত্তর না দিয়ে পুতুল খেলায় ব্যস্ত হয়ে যায়।
ছেলেটার বয়স সাড়ে তিন বছর। যখন সে ডান হাত মুখে পুরে বাম হাত দিয়ে খেলনা গাড়িটা নাড়াচাড়া করে আর অবোধ্য আনন্দসূচক কিছু শব্দ উচ্চারণ করে সালেহা বেগমের মনটা তখন আনন্দে ভরে যায়। সব কাজ ফেলে দিয়ে ছেলেটিকে তিনি বুকে জড়িয়ে আদর করেন।
পুতুলে শাড়ি পরাতে পরাতে মেয়েটা বলে, “ জানো মা ! বুবলিদের বাসায় ওরা সবগুলোর ঘরে নীল রঙের কার্পেট বিছিয়েছে !”
“হুম!” মাংসে মশলা মাখাতে মাখাতে বলেন সালেহা বেগম।
“আমাদের কার্পেট কিনবে না মা ?”
“কিনব”।
“আমরা লাল রঙের কার্পেট বিছাব মা!”
“আচ্ছা!”
বাইরে সুনসান নিরবতা। কোথায় যেন একটা রাতজাগা অচেনা পাখি বিকট শব্দে ডেকে উঠলো।
কিছুক্ষনের মধ্যেই সালেহা বেগমের স্বামী আতাউর রাহমান বাসায় ফিরলেন। বাবাকে দেখা মাত্রই ছোট ছেলেটা বাবার কোলে আসার জন্য ছটফট করে। আতাউর সাহেব ছেলেটাকে কোলে নেন। মেয়েটাও বাবার চারপাশে ঘুরঘুর করে। মেয়েটাকে কাছে ডেকে তিনি চুলে সিঁথি কেটে দেন। পকেট থেকে চকলেটের প্যাকেট বের করে মেয়েটার ছোট্ট হাতে দিয়ে দেন। তখন মেয়েটার আনন্দ আর দেখে কে ! সালেহা বেগম এসব দেখে হাসেন । সাজানো , গোছানো, শান্তির সংসার তার।
বউ বাচ্চা নিয়ে আয়েশ করে খেতে বসেন আতাউর সাহেব। মেয়েটা বাবার পাশে, বাচ্চাটা মায়ের কোলে। এক লোকমা খিচুরি আতাউর সাহেব মুখে তুলেছেন, সাথে সাথে বাইরে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। বাচ্চাটা কাঁদতে লাগল, মেয়েটা বাবাকে জড়িয়ে ধরল। সিঁড়িতে অনেকগুলো জুতার মচমচ শব্দ শোনা গেল। আতাউর রাহমান ভীত চোখে সালেহা বেগমের দিকে তাকাল। ভয়ার্ত চোখে সালেহা বেগম আল্লাহর নাম নিচ্ছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কারা যেন বাড়ির দরজা বুট দিয়ে লাথি দিতে লাগল। সালেহা বেগম বাচ্চাটার মুখে হাত দিয়ে রেখেছেন। আতাউর রাহমান মেয়েটাকে আলমারির পেছনে লুকিয়ে রাখলেন। মেয়েটার হাতে এখনো রয়েছে সেই পুতুল টি।
কয়েক রাউন্ড গুলির আওয়াজ শোনা গেল। ওরা ভেঙ্গে ফেলল বাড়ির গেট। কিছুই বলার সুযোগ দিলনা ওরা আতাউর সাহেব কে। হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে গুলি চালাল। আড়াল থেকে সব দেখল মেয়েটা। সে কাঁদতে ভুলে গেছে! তার ইচ্ছে হল বাবাকে জড়িয়ে ধরতে ! কিন্তু সে বুঝতে পারল ওই নরপিশাচ পাকিস্তানি হায়েনাদের সামনে যাওয়া যাবে না ।
মেয়েটা লাল পানির ফোয়ারা দেখতে চেয়েছিল।
তার বাবার হৃৎপিণ্ড থেকে ফোয়ারার মত লাল রক্ত বের হচ্ছে !!
এই ফোয়ারা তো সে দেখতে চায় নি !!
সালেহা চেয়েছিল স্বামীকে বাঁচাতে। কুকুরগুলো সালেহাকে বন্দুকের বাঁটের আঘাতে অজ্ঞান করে ফেলল। টেনে হিঁচড়ে তাকে কোথায় নিয়ে গেল পিশাচগুলো ?
আড়াই বছরের অবুঝ ছেলেটাকে ওরা বুটের আঘাতে কুকুরের মত মেরে ফেলল !
কি দোষ ছিল ওই বাচ্চাটার ?
একসময় কুকুরগুলো বের হয়ে গেল।
মেয়েটা বাবা আর ভাইয়ের লাশের কাছে এল। বাবার হাতে এখনো সেই খিচুরির লোকমা। ওরা বাবাকে শেষ খাওয়াটাও খেতে দিল না ! ভাইটা যেন তার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে !
ওদের চারপাশে টকটকে লাল রক্ত জমাট বেঁধে আছে।
মেয়েটা লাল কার্পেট চেয়েছিল ঘর সাজাবে বলে, কিন্তু এই থকথকে কালো হয়ে যাওয়া রক্তের লাল কার্পেট তো সে চায় নি।
বুকের মাঝখানে পুতুলটাকে জড়িয়ে মেয়েটা রাস্তায় রুদ্ধশ্বাসে দৌড় দিল।
কোথায় যাচ্ছে সে ?
মাকে খুজতে ?
কুকুরগুলো কি এখনো তার মাকে খুবলিয়ে খুবলিয়ে খায় নি ?
মেয়েটা বুঝতে পারল তার পেছনে দৌড়ে আসছে পিশাচের দল।
হাজার হাজার বুটের মচমচ শব্দ ক্রমেই ভারি হচ্ছে !
হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হৃৎপিণ্ড থেকে বের হবে টকটকে লাল রক্তের আরেকটি ফোয়ারা !
সেদিন ছিল মার্চ মাসের রাত।
হ্যাঁ ! ২৫মার্চের কালরাত্রি !

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ei Golpo Gulo Pore Bastob Jibone Keo Practice Korte Jaben Na, Moja Nin Sudhu"
Ja khusi likhun,kintu lekhok ke ukti kore kono karap comment korben na,eta sob patoker kache onurodh,kono other site link post korben na,tahole coment publish kora hobe na...................