পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৪

কেন এমন হল আমার সাথে?

রাত এগারটা। ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে বাবা সিগারেট টানছেন। আমি পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে বাবা দেখতে পায়নি। আমার কথা শুনে বাবা চমকে গেলেন। ফট করে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে আমার দিকে ঘুরে বললেন,
- কে? কে সিগারেট টানছে? কি বলিস এগুলা?
- হেহে। আব্বা তুমি ধরা পড়ে গেছ। আমি আম্মুকে বলে আসছি।

আমি সিঁড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। বাবা দৌঁড়ে এসে আমাকে ধরে বলল,
- ছি ছি! এগুলো আম্মুকে বলতে হয় নাকি? শোন তনয়, তোর আম্মা এমনিতেই ক্যাচক্যাচ প্যানপ্যান বেশি করে। এটা শুনলে তো বুঝতেই পারছিস? তুই বলিস না বাপ আমার. .
- একশ টাকা দাও।
- কেন?
- না দিলে আম্মুকে বলে দিব কিন্তু।
- আচ্ছা দিব দিব।

আমি একটা শয়তানী হাসি দিলাম।

এই হল বাবা আর আমি। মা, বাবা আর আমি মিলে আমাদের ছিমছাম মধ্যবিত্ত পরিবার। ক্লাস ফাইভে পড়ি। আমাকে যদি কেউ বলে তোমার বাবা আর মার মাঝে কাকে বেশি পছন্দ কর? আমি অকপটে বলে দিব, বাবা। ছোটবেলা থেকেই বাবার সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কেন জানি এই মানুষটাকে আমার খুব ভাল লাগে।

শুক্রবার। বাজার নিয়ে এসে আব্বু নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। জুম্মার আর বেশি দেরি নাই। তরকারি কাটতে কাটতে আম্মা আমাকে ডেকে বলল,
- ঐ তোরা কি নামাজে যাবি না? যা তোর বাপ কে উঠা।

আমি তখন আব্বুকে গিয়ে উঠাই। আব্বু আড়মোড়া দিয়ে ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
- এই যাহ! দেরি হয়ে গেল তো। গোসল করেছিস তনয়?
- আরে নাহ। এখনই ঢুকব।

তখন আমরা তাড়াহুড়া করে গোসল সেড়ে একসাথে নামাজে যেতাম। যদিও আমি নামাজ শিখিনি। আব্বার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রুকু সিজদাহ তে যেতাম।

এভাবে কেটে যাতে থাকে সময়গুলো। একসময় ক্লাস এইট পাস করলাম। বৃত্তিও পেলাম। বাবা মা যে সেদিন এত খুশি হয়েছে আমি বলে বোঝাতে পারব না। আব্বু একটার পর একটা মিষ্টি আমার মুখে তুলে দিলেন। ছোট্র পরিবারে বাবা মায়ের এই হাসি আনন্দটুকু আমার কাছে স্বর্গের শান্তি মনে হল।

কিন্তু সবসময় মানুষ হয়তো একরকম থাকে না। যতই বড় হচ্ছি ততই যেন বাবার সাথে আমার দূরত্বটা বেড়ে চলেছে। এর কারণ হয়তো বড় হচ্ছি তাই। অথবা ব্যস্ততা। আগে যেখান জুম্মার নামাজ একসাথে পড়তে যেতাম এখন সেখানে আব্বা আগে যায় আর আমি পরে যায়। এক কাতারেও দাঁড়ানো হয় না।

তবে দূরত্ব যে খুবই বেড়ে গেছে সেটাও বলা যাবে না। আব্বু আর্জেন্টিনা আর আমি ব্রাজিল।

- আব্বা টাকা দাও তো? ব্রাজিলের পতাকা কিনব।
- এই আইসে! ব্রাজিলের পতাকা কিনার জন্য টাকা দিব আমি? হোয়াট এ জোক!
- তো কি দিবা না?
- না। তুই যদি আর্জেন্টিনার পতাকা কিনিস তাহলে দিব।
- বারে আমি তো ব্রাজিলের সাপোর্টার।
- নিজের টাকা দিয়ে কিন।
- আব্বা আমি কি চাকরি করি নাকি?
- আহারে! তাইলে আর কি করা? ছাদে গিয়ে দেখ আর্জেন্টিনার পতাকা টাঙানো আছে। ঐটা দেখতে থাক!

এসময় আম্মা রুমে এসে বলল,
- ঐ তনয়, তুই এদিকে আয়। টাকা আমি দিব! এহ কোথায় ব্রাজিল আর কোথায় আর্জেন্টিনা।

আলমারি থেকে আম্মু আমাকে টাকা বের করে দিলেন। আব্বার গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে আমি চোখ টিপন্নী দিয়ে বের হয়ে গেলাম। আমি জানি আম্মা ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা কারোরই সাপোর্টার না। আম্মু খেলা দেখেন না, বুঝেন না। তবুও আম্মা এই বাপ বেটার ঝগড়া উপভোগ করেন। এই ঝগড়ার মাঝেই হয়তো বাপ বেটার তৃপ্তিময় ভালবাসা খুঁজে পান।



কাল থেকে আমার এসএসসি পরীক্ষা। রাত জেগে পড়ছি। পড়ালিখার ছাত্র আমি নই। কেন জানি পড়ালিখাটা আমার ভাল লাগেনা। প্রায় তিনটা পর্যন্ত পড়লাম। তারপর ঘুমাতে গেলাম। সকালে উঠে নাস্তার টেবিলে নাস্তা করছি। আব্বু শেভ করতে করতে বলল,
- আজকে কি পরীক্ষা রে?
- বাংলা। আব্বুর প্রশ্ন শুনে আমি নিজে নিজেই হাসি। আমার আব্বুটা এরকমই। পড়ালিখা নিয়ে কখনোই তার মাথাব্যথা নেই। তবে মাঝে মাঝে উপদেশ দিতেন। "তনয়, ভালমত পড়ালিখাটা করবি। মানুষ হবি। একসময় হয়তো আমি থাকব না। তখন তোর মাকে তোকেই দেখতে হবে। জীবনটা তোর। সেটা উপভোগ করবি। পাশাপাশি পড়াশোনাও ঠিক রাখবি ।"

কিন্তু খারাপ সময় আমার জীবনে আসল। রেজাল্ট ৪.৯। মানে এ+ পাইনি। আব্বা রেজাল্ট শুনে হাসি দিলেন। পিঠ চাপড়ে বললেন, "আরে ভালই তো করসিস! মন খারাপ করিস ক্যান? পরেরবার আরো ভাল করবি ।"

আচ্ছা আব্বার কি মন খারাপ হয়নি? নাকি মিছামিছি অভিনয় করছেন?

সারাটা দিন আমার মন খারাপ ছিল। আব্বুর মোবাইলে ফোন আসতেই থাকে। অমুক কলিগের ছেলে এ+ পেয়েছে, তমুক কলিগের ছেলে এ+ পেয়েছে। শুধু আমি পাইনি। রাতে বারান্দায় চুপচাপ বসে আছি। একসময় আম্মু এসে গ্রিল ধরে দাঁড়ালেন। বাইরে তাকিয়ে থেকে বললেন, "তোর বাবার চোখে আজ প্রথম পানি দেখলাম ।"

আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেই এবার।
- আমি পারিনি আম্মু। আমি ব্যর্থ।
- ছি বাবা এসব বলিস না!

তারপর একসময় কলেজে উঠলাম। আবার সব আগের মত। হাসিখুশি একটি পরিবার। তবে ভিতর ভিতর আমি শান্তি পাচ্ছি না যতদিন না এইচএসসি তে এ+ পাব।

আর বয়সেরও একটা দোষ আছে। এসময়টা খুবই ডেন্জারাস। কলেজের ফার্স্ট ইয়ার পার হতে না হতেই আমি প্রেমে পড়ে গেলাম। মেয়েটির নাম তাবিহা। একই ক্লাসে পড়ি দুজন। খুব ভাল বন্ধু আমরা। অতঃপর বন্ধু থেকে একসময় রিলেশন। ও যথেষ্ট কেয়ারিং।


একদিন দুপুরে বিছানায় বসে ফেসবুকিং করছিলাম। আব্বু আমার পাশে বসে বললেন,
- কিরে তনয় কি করছিস ?
- এইতো শুয়ে ছিলাম।
- তা মেয়েটা কে?
আমি অবাক হয়ে বললাম, - কোন মেয়ে?
- আজকে দুপুরে দেখলাম একসাথে ফুচকা খাচ্ছিলি।
- ও তাবিহার কথা বলছ? সে খুব ভাল ফ্রেন্ড আমার।
- হেহে। শুধুই কি ফ্রেন্ড?

আব্বা এমনভাবে কথাটা বলল যে আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।
- না মানে ইয়ে. . . .
- তোর বয়সটা আমিও পার করে এসছি। এটা কোন ব্যাপারই না। তোর মাকে প্রথম দেখার পর খালি পিছু পিছু ঘুরতাম। ঘটনা শোন তাহলে। আব্বু তখন ঘটনা শোনাতে লাগল। ঘটনা শুনছি আর আমরা দুজনই হাসাহাসি করছি। প্রপোজ, বন্ধুদের হারামীপনা সবকিছুই শোনালেন।


সময় যেতে থাকে। এইচএসসি রেজাল্ট ঘনিয়ে আসছে। পরীক্ষা এবার ভাল হয়েছে। রেজাল্টের দিন সকাল থেকেই আমার মাঝে উত্তেজনা। ঠিক করেছি যদি এ+ পাই তবে বাবাকে আমি নিজ হাতে মিষ্টি খাওয়াব।

দুপুর বারটা। কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হলাম। বাবা বললেন,
- কিরে রেজাল্ট তো দুটার পর। এখনই কলেজে যাচ্ছিস?
- হ্যাঁ আব্বু। বন্ধুরা ডাকাডাকি করছে।
- তোর গার্লফ্রেন্ড ডাকাডাকি করছে না?
- যাও আব্বু সবসময় খালি ইয়ার্কি।
- হেহে। আচ্ছা ইয়ার্কি করব না।

আমার কি মনে হল কে জানে আব্বুর পা ছুঁয়ে সালাম করে বলেই দিলাম,
- মিষ্টি নিয়ে আসছি। মুখে তুলে খাইয়ে দিব তোমাকে।

আব্বু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবার হাসিমাখা মুখটি দেখে বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে।


দুপুর দুটা। আমি এ+ পেয়ে গেছি। ভাবলাম বাসায় গিয়ে রেজাল্টটা বলব। কিন্তু পারছি না আর। মোবাইলটা হাতে নিয়ে আম্মুকে ফোন দিলাম। আম্মু কল ধরলেন। আম্মা কাঁদছে।
কি ব্যাপার কাঁদছে কেন? আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমি তাড়াতাড়ি বললাম,
- আরে কাঁদছ কেন?
এ+ পেয়েছি তো।
- তনয়, তোর বাবা আর নেই।

কথাটা শুনে আমি শকড। কি বলছে এসব? আম্মু বলেই যাচ্ছেন। আমি শুনতে পাচ্ছি না। আসলে শুনছিনা। ব্রেন স্ট্রোক না কি যেন বললেন আম্মু! আমি আর পারছিনা।

তবুও আমি মিষ্টি কিনলাম। তারপর হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিলাম রিকশাতে। এটা কিভাবে সম্ভব ? দুঘন্টা আগেই তার পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ওটাই কি শেষ বুকে জড়ানো ? নাহ আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।


মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে দরজাতে ঠাই দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাবার নিথর দেহটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। মা আমাকে ধরে ভেতরে ঢোকালেন।

- তোর বন্ধুদের রেজাল্ট কেমন? মুখ দিয়ে কথা বের হয়না। গলাটা ধরে এসছে।
- হ্যাঁ ভাল।
- মিষ্টির প্যাকেটটা খোল। খাইয়ে দে আমাকে।

আমি এবার মাকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, "কেন মা? কেন এমন হল আমার সাথে? আমি যে বাবাকে খাইয়ে দিতে চেয়েছিলাম মা। বাবা কেন চলে গেল? কেন?"

বাবার মুখটা শেষবারের মত দেখলাম। এখনও সেই হাসিটা মুখে লেগে আছে যেটা দেখে আমি বাসা থেকে বের হয়েছিলাম।

অপূরণীয়

গোমড়া মুখে স্কুল থেকে বের হচ্ছে অণু; স্কুলটাকে অনেক বেশি ভালবাসে; সবসময় স্কুলে থাকতে ইচ্ছে করে; সবার সাথে খেলতে ইচ্ছে করে; স্কুলটা যে কেন ছুটি হয়! সাপ্তাহিক ছুটিটা মানা যায়। কিন্তু রোজা এবং ঈদের জন্য পুরো একমাস ছয় দিন ছুটি! এতদিন বাসায় বসে বসে কি করবে! হয়ত এমন সব অদ্ভুত চিন্তা ভাবনার মধ্যেই আমার সাথে দেখা হয়ে গেল ওর। ... না, অণু কোন স্কুল ছাত্রী নয়। এই স্কুলের একজন শিক্ষিকা। ক্লাস নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় প্রতিদিনই কিছু উদ্ভট চিন্তা করে। এমনকি সব ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত অণুও বের হয় না। অণুর ডাকে আমি বর্তমানে ফিরে আসি।

-জানো, আজকে থেকে লম্বা ছুটি।
-হুম, শুনলাম। ছাত্র-ছাত্রীরা বলাবলি করছিল।
-এত্ত লম্বা ছুটি দিল কেন? একটু কমও তো দিতে পারত।
-রোজা রেখে ক্লাস করতে ছাত্র-ছাত্রীদের অসুবিধা হবে না?
-অনেকটা ঠিক। কিন্তু আমি তো ..........
-আচ্ছা বাদ দাও। আইসক্রিম খাবে? আজকেই কিন্তু সুযোগ। কাল থেকে খেতে দিব না। রোজার মধ্যে জ্বর-সর্দি-কাশি হোক তা আমি চাই না।
-[একটা মিথ্যা হাসি দিয়ে] হ্যাঁ, খাবো। অনেকগুলো কোণ আইসক্রিম নিয়ে আসবা।
-অসম্ভব। একটার বেশি কখনই না।
-তাহলে কিন্তু রাগ করব।
-তুমি রাগ করলে আমি ভাঙাবো।
-এইবার তোমার মন ভুলানো কথায় আর ভুলছি না।
-তাহলে আর কি! বিয়ে আরেকটা করে নিব।
-আহ্! শখ কত! নিজেকে আয়নায় দেখেছ? কোন পাগলী তোমাকে বিয়ে করবে! -তুমিই তো সেই পাগলী।
-[খানিকটা নিরবতার পর] আমি তোমার পাগলী হয়েই থাকতে চাই। সারাজীবন। [আমার কাঁধে মাথা দিয়ে রাখে]
-আইসক্রিম নিয়ে আসব?
-না, এখন এইভাবেই থাকতে ভাল লাগছে।
-কোথাও যাবা? -না। বাসাতেই যাই।
-আচ্ছা।

মন খারাপ হলে অণুকে অনেক মায়াবী লাগে। আবার ওর মন খারাপ ঠিক করতে হলে ওর সাথে দুষ্টু-মিষ্টি ঝগড়া অথবা ওর কোন পছন্দনীয় জায়গায় নিয়ে গেলেই সব ঠিক। কিন্তু এই প্রখর রোদে দুপুর বেলা কোথাও নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। বাসাতেই যাই। তারপর কথা বলতে বলতে ঠিক করে নিব।

আমার সাথে অণুর পরিচয় হয় পাঁচ বছর আগে। পরিচয় বললে ভুল হবে। কাকতালীয় ভাবে অনেকটা দেখা হওয়ার মত। পদ্মা নদীর তীরে ফুচকার দোকানে। ফুচকা খেতে খেতে ফোনে কার সাথে যেন তুমুল ঝগড়া করছিল। ওর ফ্রেন্ডরা ওকে থামাতে চাইলেও থামাতে পারছে না। গলাবাজির পরিমাণ আরও বেড়েই চলেছে। দেখতে অসম্ভব সুন্দর না হলেও অতটা খারাপও না। কেন জানি দেখতে ভালই লাগছিল। আমার সাথে দুইজন ফ্রেন্ড ছিল। তিনজন মিলে ওর কথাবার্তা নিয়ে ভালই মজা করছি। মেয়েটা ফোনেই একটা ফোন নাম্বার বলতে লাগে। আমি তো তড়িঘড়ি করে নম্বরটা আমার ফোনে তুলে নিই। ওরা সবাই উঠে চলে যায়। আমরা তিনজন বলাবলি করতে থাকি, নাম্বারটা কার? ঐ মেয়েটার হতে পারে নাও পারে। ভাগ্য পরীক্ষা করতে অসুবিধা কি! নাম্বারটাতে টোকা তো দিবই। কয়েকদিন পর গভীর রাতে ফোন করি। মিস কল দিব ভেবেও মিসকল দেওয়া হল না। মেয়েটা ফোন ধরে নেয়! নিজেই বলতে শুরু করে,

-এত রাতে আননোন নাম্বার থেকে ফোন দেন কেন? [কথা শুনেই মোটামুটি সিওর এই মেয়ে সেই মেয়ে]
-না, মানে... [আমি তখন এসব বিষয়ে অজ্ঞ]
-মানে মানে করলে তো হবে না। ফোন যখন দিছেন তখন কি বলবেন বলেন।
-এত রাতে জেগে আছেন?
-আমি জাগলে আপনার সমস্যা কি!
-শরীর খারাপ করতে পারে।
-আমার শরীর খারাপ হয় না। আপনি বলুন আপনি কেন জেগে আছেন?
-আপনাকে ফোন দিব বলে।
-দেওয়া শেষ। এখন ঘুমান।
-আরেকটু কথা বললে.....
-থামলেন কেন? বলুন।
-না কিছু না।
-আপনি কি করেন?
-পড়াশুনা।
-আমার নাম্বার কোথায় থেকে পাইছেন?
-আপনিই তো দিলেন।
-কবে? আমি কি আপনাকে চিনি?
-আপনি চিনেন না। তবে আমি চিনি।
-কিভাবে?
-ফুচকার দোকান, পদ্মার পাড়। আপনি তো অনেক ধমকাতে পারেন।
-আরে না। সেদিন অনেক বেশি মাথা গরম ছিল। কিন্তু আমার নাম্বার কি করে পেলেন সেটা তো বললেন না।
-আপনার সেইদিনের কথার মাঝেই আপনি বলেছিলেন।
-আপনি কি আড়ি পেতে ছিলেন?
-আপনি যত জোরে বলছিলেন তাতে তো আরও কয়েকজন মানুষের এই নাম্বার পাওয়ার কথা।
-আর বলবেন না! রাগলে মাথা ঠিক থাকে না।
-এখন তো ভাল আছেন। এখন একটু ভালমত কথা বলেন শুনি।
-কেন বলব? আমি তো আপনাকে চিনিই না।
-চিনতে দোষ কি! চিনে ফেলুন।

.....অনেকটা এমনই কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আমাদের সম্পর্কের শুরু হয়েছিল। ফোনে কথা, মেসেজিং, দেখা করা, ঘুরে বেড়ানো এসব প্রায়ই হত। সম্পর্ক ভালবাসাতে রূপ নিয়েছিল। অণুকে প্রথমে যতটা রাগী ভেবেছিলাম ও ততটা রাগী নয়। আসলে ও রাগতেই জানে না। রাগের অভিনয় করে মাত্র। ওকে পাওয়ার পর বুঝেছিলাম, ভালবাসা কি। এর অর্থ কি। তাই ওকে ছাড়া আমার সামনের জীবন পাড়ি দেওয়া অসম্ভব ছিল। পারিবারিক কোনো ঝামেলা হয় নি। আমাদের দুজনকেই মেনে নিয়েছিল। সে জন্য আমাদের তেমন কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় নি। কিন্তু কে জানত, সামনে কি আছে?

অণুর জীবনে এক দুর্ঘটনা ঘটে। সিরিয়াস অবস্থা। ও বাঁচবে কিনা এটা নিয়েও ছিল সংশয়। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় ও বেঁচে যায়। কিন্তু ডাক্তার জানায়, ও কোনোদিন মা হতে পারবে না। এ কথা যে কোনো মেয়ের কাছেই সবচেয়ে দুঃখজনক। অণুর নিজেকে সামলাতে সময় লাগে। ও আমাকে বিয়ে করতেও সংকোচবোধ করে। ওকে অনেকভাবে বুঝানোর পর রাজি হয়। বিয়েটা হয়।

আমি হয়ত বাবা হতে পারব না। কিন্তু আমার চেয়ে বেশি কষ্ট অণুর। বেঁচে থাকার জন্য ভালবাসা কম না। হয়ত কিছু অংশ অপূর্ণ থাকবে কিন্তু তাই বলে জীবনটাতো থেমে থাকবে না। একজন জীবনে সবকিছু পায় না। আমাদের ক্ষেত্রেও হয়ত তেমনই। অণু নিজেকে হালকা করার জন্য ছোটদের এই স্কুলে পড়ায়। তাদের কথাবার্তা শুনে হাসে। একেকজনের বায়না দেখে বিস্মিত হয়। এভাবে যদি সে নিজের জীবনের কিছুটা অংশ ভুলে থাকতে পারে তবে ক্ষতি কি! হ্যাঁ, আমরা ভাল থাকব। এই বিশ্বাস নিয়েই একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে আছি।

যদি ভুল করে বলে ফেলো ভালোবাসি

তমাল এবং রিয়া কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড। ওদের দুজনের প্রথম এবং প্রধান কাজ ছিল পড়াশুনার গুল্লি মেরে এখানে সেখানে টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। কখনো দূরে কোথাও পুকুর দেখতে যাওয়া। পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে এলোমেলা কথার ফুলঝুরি ছোটানো। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাওয়া। ঝালের চোটে চিৎকার করে ফুচকাওয়ালাকে ভড়কে দেয়া। রিক্সায় চড়ে বার কয়েক শিরোনামহীন রাস্তায় চক্কর দেয়া। টং দোকানের ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দেয়া। শপিং মলে ঘুরে ফিরে ক্লান্ত মেঝেতে বসে পড়া। অনেকে বলতে পারে এগুলো হয়তো কৈশর বয়সের পাগালমি। বিবেকবোধ জাগ্রত হলে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। আসলেই কি তাই? হয়তোবা এর মাঝে সুপ্ত একমুঠো ভালবাসা লুকিয়ে আছে যেটা সকলেরই দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেছে।

এত সুখ এত আনন্দ ওদের জীবনে বেশিদিন সইলোনা। এইচ.এস.সি শেষ হতে না হতেই রিয়া পরিবারসহ হাজার মাইল দূরের দেশ আমরিকায় পাড়ি জমায়। ওখানে যাবার প্রথম কয়েকদিন দুজনের খাওয়া দাওয়া ঘুম সবই হয়েছিল কম্পিউটারের সামনে। ধীরে ধীরে রিয়া নিজেকে ঐ দেশের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে শুরু করলো। আর তমালও ভার্সিটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। একদিন দুদিন করে সময় গড়াতে লাগলো এবং একসময় যে যার পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেলো কারন কথায় আছে "আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড"।

সারারাত মুভি দেখে এবং ফ্রেন্ডদের সাথে চ্যাটিং করে সকাল ৬ টার কিছু পরে ক্লান্ত দেহে বিছানায় গেলো তমাল। শোবার সাথে সাথেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মনে হয় একটা স্বপ্ন দেখছিলো। স্বপ্নে যখন কঠিন ক্ল্যাইম্যাক্স তখনি মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। কতক্ষন ঘুমিয়েছে তমালের জানা নেই মনে হলো মাত্রই চোখ বন্ধ করেছে এরই মধ্যে ফোন। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফোন রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে ধমকের সুরে বলে উঠলো, "এখনও ঘুমাচ্ছিস? তাড়াতাড়ি হ্যালেভেশিয়াতে আয় আমি ওখানে একা একা বসে আছি।"

"এই কথা শুনতেই তমাল লাফিয়ে উঠে বিছানায় বসে পড়ে এবং অবিশ্বাসমাখা কন্ঠে বলে ওঠে, “তু তু তুইইই কবে দেশে এলি?" অপরপ্রান্ত থেকে জবাব আসে, "গতকাল। তোকে সারপ্রাইজ দিবো ভেবে আগে থেকে কিছুই জানাইনি। যাইহোক ৩০ মিনিটের মধ্যে চলে আয় নাহলে আমি চলে যাবো বলে দিলাম।" এই কথা শুনে তমাল বললো, "তুই থাক আমি এখনি আসছি" ফোন রেখে কোন মতে ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় পরে ঘর থেকে বের হতে যাবে তখনই সামনে মা এসে পড়ে, মাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে বলতে লাগলো "আমি বাইরে যাচ্ছি আসতে দেরী হবে। বাহিরেই খেয়ে নিবো।"

পেছন থেকে মায়ের হুংকার " সারারাত ঘুম নেই, খাওয়া নেই। এখন কোথায় যাওয়া হচ্ছে?" মা বলেই যাচ্ছে আর তমালও দরজা খুলে পা বাড়িয়েছে। আস্তে আস্তে মায়ের কন্ঠ মিলিয়ে যেতে লাগলো।

হ্যালভেশিয়ার ঢুকে সাদা জামা পরা মেয়েটাকে দেখে চিনতে একটুও ভুল হলনা তমালের। একবছর পর দেশে ফিরে এসেছে রিয়া। পুরো পরিবারসহ আমেরিকায় চলে গিয়েছিল গত বছর। এখন হঠাৎ করে কি মনে করে দেশে ফিরে এলো এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে রিয়ার পাশে বসে পড়ে তমাল। বসতে না বসতেই রিয়া বলে উঠে, "হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস্ ডে।"

এ কথা শুনে তমাল যেনো আকাশ থেকে পড়লো কারন ওর মনেই ছিলনা আজকে ভ্যালেন্টানস্ ডে। এর উত্তরে খুব ছোট্ট করে বললো, "সেম টু ইয়্যু।"
"হঠাৎ কি মনে করে দেশে ফেরা হলো?"
রিয়ার স্বভাবসুলভ উত্তর, "মন চাইছে চলে আসছি। তোর কোন সমস্যা? সমস্যা থাকলে বল আমি এখনই চলে যাই।"
"আরে আরে আমি তো এমনিই জানতে চাইলাম। বলা নাই কওয়া নাই হঠাৎ চলে এলি তাই একটু কিউরিয়াস দ্যাটস্ অল।"
"মনে আছে তোকে কথা দিয়েছিলাম ভ্যালেন্টাইনস্ ড্যা তে তোর সাথে কাটাবো? তাই ৭ দিনের ছুটিতে চলে এলাম।"
তমাল চরম বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো, "তুই কি একা এসেছিস?"

রিয়া মিটি মিটি হাসতে হাসতে বললো, "হুম, একা এসেছি এখানেও তোর প্রবলেম? সরে যা আমার সামনে থেকে আমি গেলাম।"

-"আরে কি করছিস । আমি কি কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারবো না নাকি?"

--"পারবি। তবে এখন না। এখনি সব বলে ফেললে সারাদিন ধরে করবো টা কি?"

-"সারাদিন আমার সাথে থাকার প্ল্যান?"

--"অবশ্যই। কেন তোর কোন অসুবিধা আছে? কোন মেয়ের সাথে ডেটিং ফিক্সড হয়ে আছে? অসুবিধা থাকলে বল আমি এখনই চলে যাই।"

-"আরে আমি কি তাই বলেছি নাকি? রিয়া তোর কথায় কথায় রাগ করার অভ্যাসটা এখনও গেলো না।"

--"হুম, গেলো না। আর আমি রাগ না করলে তো তুই বেকার হয়ে যাবি। তোর তো তাহলে আর কোন কাজ থাকলো না। এই কথা বলে খিল খিল করে হাসতে লাগলো। যাইহোক কি খাবি বল শুনি। অর্ডার দিয়ে আসি।"

খাবারের অর্ডার দিয়ে এসে ওদের দুজনের কথা চলতে থাকলো। তমাল জিজ্ঞেস করে, "তোর ওখানকার লাইফ কেমন কাটে? ভালো লাগে?"

--"না লাগলেও তো কিছু করার নেই তাই না? প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো সেটা তুই ভালো করেই জানিস। এখন আর তেমন কিছু মনে হয় না।" ক্লাস শেষ করে জবে যাওয়া এবং সেখান থেকে বাসায় ফিরে নিজের কাজ নিজে করা। সত্যি বলতে নিঃশ্বাস ফেলারই সময়ই পাইনা ভাববো কখন? তবে উইকেন্ডে বের হয়ে আমাদের বয়সী কাউকে দেখলে বুকের মাঝে একধরনের শূন্যতাবোধ কাজ করে। তখন মনে হয় সবকিছু ছেড়ে দিয়ে আবার দেশে ফিরে আসি। আবারও স্বপ্নের দিনগুলোতে ফিরে যাই।"

বলতে বলতেই ওদের ডাক পড়লো খাবার নিয়ে আসার জন্য। খেতে খেতে অনেকদিনের জমানো কথাগুলো উগড়ে দিতে লাগলো দুজনে। আশেপাশে কে আছে না আছে কোন দিকেই ওদের দৃষ্টি নেই। এ ভুবনে শুধু ওরা দুই মানব মানবী ছাড়া আর কারও যেনো অস্তিত্ব নেই। বাকি সবকিছু কিছু সময়ের জন্য ফ্রিজ হয়ে আছে।

রিয়া বলে যায়, "তোর মনে আছে আমার চলে যাবার দিনের কথা? ইস কি খারাপটাই না লাগছিলো! মনে হচ্ছিলো জীবনে আর কখনও ঐভাবে ঘুরাঘুরি করতে পারবোনা, মজা করতে পারবো না এটা ভেবে কাঁদতে কাঁদতে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছিল। জানিস ওখানে বন্ধু বান্ধব হয়েছে এবং উইকেন্ডে আমরা এখানে সেখানে ঘুরতে বের হই। কিন্তু আগের মত মজা পাই না। ওখানে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও কেমন জানি ধূসর। কারো সাথেই আমি স্বাভাবিক হতে পারি না কোনভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি না। ওখানকার জীবন অনেক বেশি আলাদা।"

রিয়ার মন খারাপ হচ্ছে বুঝতে পেরে খাওয়া শেষ হতেই তমাল বললো, "চল রিয়া এবার বের হই। তোকে নিয়ে অনেকদিন রিক্সায় ঘুরি না। আজকে অনেক সময় নিয়ে ঘুরে বেড়াবো" রিক্সায় ঘুরার কথা শুনে রিয়া চমকে উঠলো আর চিৎকার দিয়ে উঠলো, "ইসসসসসসসস কত্তদিন রিক্সায় ঘুরি না।" লাফিয়ে উঠে তমালকে সরিয়ে দিয়ে সোজা গেট দিয়ে বের হয়ে গেলো। রিয়ার মাইন্ড খুব সহজেই অন্যদিকে ডাইভার্ট করা যায়। তমাল ওর পাগলামি দেখে অভ্যস্থ তাই একটুও অবাক না হয়ে বের হয়ে রিক্সা ঠিক করে উঠে পড়ে।

বেইলি রোড থেকে রিক্সায় উঠে ঘুরতে ঘুরতে যখন টি.এস.সির দিকে গেলো তখন টি.এস.সির অবস্থা দেখে দুজনের চোখ ছানাবড়া অবস্থা। ওদের মনে হলো ঢাকার আর কোন ছেলে মেয়ে বাদ নেই সব টি.এস.সিতে এসে হাজির হয়েছে। ওদের রিক্সা কোনভাবেই এগুচ্ছে না। এগুলা নিয়ে ওদের মাথা ব্যাথা নেই। ওরা ওদের মত গল্প করেই যাচ্ছে। অনেক দিন পর রিয়াকে কাছে পাওয়ায় রিয়ার প্রতি তমালের পুরোনো ভালোবাসা আবার জেগে উঠেছে। এবং এক পর্যায়ে তমাল ভীষন আগেবী হয়ে রিয়ার কাছে জানতে চায়, "আমাদের মধ্যে কি কখনই কিছু সম্ভব নয়?"

তমালের প্রশ্নে রিয়া একটু আনমনা হয়ে গেলো। কিছু সময় পরে বলতে লাগলো, "দেখ তমাল আমার আগে একটা রিলেশন ছিলো। তুই আমাকে একসময় অনেক সাপোর্ট দিয়েছিস। তোর কাছে আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ। তোর জন্য আমি সবকিছু করতে পারি। এই যেমন আজ আমি ফ্যামিলি ছেড়ে এত দূর ছুটে এসেছি শুধু তোর জন্য। আমি সব পারবো শুধু তোর সাথে সম্পর্কে জড়াতে পারবো না। কারন তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমি তোকে ধোঁকা দিতে পারবো না। আমি আমার এক্সকে এখনও লাভ করি। আমি তোর ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারবো না। ইয়্যু ডিসার্ভ বেটার দ্যান মি।”

তমাল বললো, "তুই আমাকে একদিন বলেছিলি যেটা আমার এখনও মনে আছে আর তা হলো একসাথে থাকতে থাকতে ভালোবাসা হয়ে যায়। আমাদের চেষ্টা করতে দোষ কি? আই লাভ ইয়্যু মোর দেন এনিথিং এ্যান্ড ইয়্যু নো দ্যাট।” রিয়া তার কথায় অটল সে তমালের জন্য সব কিছু করতে পারবে শুধু রিলেশনশিপে যাওয়া ছাড়া। তমাল অনেক আকুতি মিনুতি করে শেষ পর্যন্ত চুপ করে গেলো। রিক্সা তখন হাইকোর্টের সামনে দিয়ে প্রেসক্লাবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

আকাশের রক্তিম আভা যেন ছড়িয়ে পড়েছে রিয়ার সারা মুখে। তমালের ইচ্ছে করে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলতে, তুই কেন বুঝিস না তোকে আমি কতটা ভালবাসি? আর কতটা ভালবাসলে তুই আমার হয়ে যাবি? আর কতটা ভালবাসলে তোর সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে শুধু আমিই থাকবো? আর কতটা ভালবাসলে তোর কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে আমার অর্থহীন জীবনটা সার্থক হয়ে যাবে?

সন্ধ্যা হবে হবে এমন সময় রিয়া বলে, "আমি প্রচন্ড টায়্যার্ড ফিল করছি আমি কি তোর কাঁধে মাথা রেখে একটু ঘুমাতে পারি? আর একটা কথা উনাকে বল যে রিক্সা বনশ্রীর দিকে নিতে। এই রিক্সায় করেই বাসায় যাবো।"

এই বলে রিয়া তমালের কাঁধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গেলো।

এতক্ষন ধরে কষ্ট করে জমিয়ে রাখা চোখের জলগুলো বৃষ্টিধারার মত নীরবে গড়াতে লাগলো। রিয়া গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আর অন্ধকারে চলছে তমালের নীরব অশ্রু বিসর্জন। দুজনে এতটা কাছাকাছি থেকেও যেন কত দূরে। ঘুমের মাঝে রিয়ার ঠোঁটের কোনে একচিলতে হাসি ফুটে উঠেছে। ঘুমের মাঝে হয়তো কোন সুখো স্বপ্ন দেখছে। একগুছো চুল এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ওর সারা মুখ জুড়ে। তমাল খুব সাবধানে চুলগুলো সরিয়ে দিলো যেনো সহসাই ঘুম ভেঙ্গে হাসিটা মিইয়ে না যায়।

রিক্সা যখন রামপুরা ওভারব্রীজ দিয়ে বনশ্রীতে ঢুকছে তখন তমাল আলতো স্বরে ওর নাম ধরে ডাকে। ওকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে বলে, “সরি তোকে ডিস্টার্ব করার জন্য। তোর বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি।”

চোখ ডলতে ডলতে রিয়া বললো, “থ্যাংকস্ এ্যা লট তমাল এত সুন্দর একটা দিন উপহার দেয়ার জন্য।”

তমাল বললো, "আরে আমি আবার কি করলাম? ইয়্যু মেইড মাই ড্যে। তুই যদি সাত সাগর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে না আসতি তবে..."

"এ্যানিওয়েজ... হ্যাপি ভ্যালেন্টাইনস্ ড্যা ওয়্যানস্ এগেইন” বলে বিদায় নিতে যাবে রিয়া...


তখনি দাঁড়া বলে তমাল কি মনে করে ওয়ালেট বের করল। সেখান থেকে শতছিন্ন এক টুকরো কাগজ বেরুলো... সেখানে কিছু লেখা। রিয়া বুঝতে পারলো না তমাল কি চাইছে। তমাল মোবাইল বের করে মোবাইলের মৃদু আলোয় আবৃত্তি শুরু করল...

আমি এখনও অপেক্ষায় আছি
যদি কখনও ভুল করে বলে ফেলো ভালোবাসি।
এমন কিছু ক্ষতি হবেনা পৃথিবীর
বদলে দিতে হবে না কোন সংবিধান,
কমে যাবে দীর্ঘশ্বাস আর অপেক্ষার জন্ম নিবে
আরেকটি নতুন সুখ সত্তার।
আমি এখনও অপেক্ষায় আছি
যদি অন্যায়গুলো অনুশোচনায় বদলে যায়
এমন কিছু ক্ষতি হবে না সময়ের,
হারিয়ে যাবে দুঃখ আর হতাশা
জন্ম নিবে আরেকটি কাঙ্খিত পৃথিবীর।
আমি এখনও অপেক্ষায় আছি
যদি ভুল করে বলে ফেলো
আমি, আমরা অনুশোচনায় কাতর
নিজের মত ভালোবাসি তোমাকে তোমাকে আর
তোমাকে..!

এইতো ভালোবাসা

ভালবাসা জিনিষটা কী জানেনা ফাল্গুনী। সে শুধু জানে মৃন্ময় নামের ছেলেটাকে সে ভালবাসে। যে টান মৃন্ময়ের কথা তাকে ভাবায়, মুগ্ধ করে রাখে, আচ্ছন্ন করে রাখে সারাক্ষন, কারণে অকারণে মৃন্ময় এর ছবি ভাসিয়ে তুলে চোখের তারায়, সে টান টাই হয়তো ভালবাসা। এত টুকু জানলেই চলতো তার। তবে ফাল্গুনী আরও জানে।

সে জানে মৃন্ময়কে সে ভালবাসে, আর মৃন্ময় নামের ছেলেটাও তাকে প্রচণ্ড ভালবাসে। এইত সকল জানা, সকল পাওয়া এই জানার মাঝেই। পৃথিবীর সবগুলো প্রশ্ন, সবগুলো অভিমান, সবগুলো চোখের পানি, সবকটা স্বপ্নের উত্তর আর সব সমস্যার সহজ সমাধান একটা কথাই, ভালবাসার মানুষের কাছ থেকে ভালবাসি কথাটা শোনা।

আজ ঠিক ২১ দিন পর ফাল্গুনী সাথে দেখা হচ্ছে মৃন্ময়ের। ফাল্গুনী সবসময় সাধারণ থাকতে পছন্দ করে। সাজুগুজু জিনিষটা খুব একটা পছন্দ না তার। শুধুমাত্র সাজুগুজু করাকেই সৌন্দর্য বলেনা। সৌন্দর্য এমন একটা ব্যপার যা মন থেকে আসে। আর সবার ভেতরেই সৌন্দর্যটা আগে থেকেই দিয়ে দেয়া। সেটাকে বের করতে সাজুগুজু করতে হয় না।

তবে ফাল্গুনী আজ আয়নার সামনে বসে আছে। সে আজ সাজুগুজু করবে। হালকা সাজল সে। এতদিন পর দেখা বলে কথা। সবাই একটু এলোমেলো হয়ে যায় এই সময়ে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিতে যাবে এই সময়ে হাত থেকে লিপস্টিক পড়ে গেল তার। ফাল্গুনী কুসংস্কারে বিশ্বাসী নয়, তাও কি মনে করে যেন আর লিপস্টিক দিলো না ঠোঁটে। জামা, ওড়না, ব্যগ সবকিছুই ঠিকঠাক ফাল্গুনীর। একদম তৈরি সে। কিন্তু সমস্যাটা পায়ে। পায়ে তার স্পঞ্জ। বাসায় পরার স্পঞ্জ। স্যান্ডেলটা রাতে ছিঁড়ে গিয়েছিলো হালকা। সে মুচির কাছে রেখে এসেছে সেলাই করে দেবার জন্য। রাতে দেরি হয়ে যাওয়ায় আনেনি। তবে সমস্যা নেই, রাস্তাটা ওদিকেই। যাবার সময় স্পঞ্জ টা রেখে জুতোটা নিয়ে যাবে।

ফাল্গুনী হেটে যাচ্ছে। মনে অনেক আনন্দ। সে ভাবছে, ইসশ! ছেলে হলে গলা ছেড়ে একটু গান গাওয়া যেতো। মেয়ে হলেও গাওয়া যায়, কেউ কিছু বলবেনা। তবে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকবে। এত বড় একটা মেয়ে রাস্তায় জোরে গান গেয়ে যাচ্ছে, চোখ বড় করারই করার কথা। এসব ভেবে হাসছে সে, তবে শুধু যে এই কারণে হাসছে এমনটা না।

তার মুখে হাসি লেগেই আছে, আর চোখে কিছু দুষ্টু দুষ্টু চাহুনি। কেউ যখন বেশি খুশি থাকে তখন সে অট্টহাসি হাসে না, ঠোঁটের কোণে একটা হাসি লেগেই থাকে, থামে না। হাসতে হাসতে মানুষটার গাল দুটোতে ব্যথা হয়ে যায়, তবু ও হাসি থামে না। থামাতে চাইলে ও থামানো যায়না। ফাল্গুনীরও এখন এই অবস্থা, সেও এরকম হাসছে। হাসবেই বা না কেন? আজ যে সে অনেকদিন পর দেখা পাবে তার স্বপ্নবালকের।


হঠাৎ করেই ফাল্গুনীর মুখটা কালো হয়ে গেলো। মুচি ছেলেটার বসার জায়গা খালি। ছেলেটা এখনও আসেনি। মুচি ছেলেটা নেই, জুতো এখন না নেয়া গেলেও পরে নেয়া যাবে। কিন্তু মৃন্ময় এর সাথে দেখা করার কি হবে! এভাবে স্পঞ্জ পায়ে ভালবাসার মানুষের সাথে দেখা করতে যাওয়াটা কেমন যেন দেখায়! যদিও মৃন্ময় কিছুই বলবেনা, আর এটি বলার মত কোন বিষয়ও না। তবুও কেমন একটা খারাপ লাগা ভাব থেকেই যায় নিজের মাঝে! এতদিন পর দেখা হচ্ছে, সেই দিন ই যদি সে স্পঞ্জ পড়ে যায়, ব্যপারটা অবশ্যই ভাল দেখায় না!

চোখে মুখে চিন্তার রেখা ফোটে উঠেছে ফাল্গুনীর। একরকম অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে তার। এই সময় হঠাৎ করে ছেলেটাকে হন্তদন্ত হয়ে ছোটে আসতে দেখা গেলো। আসতেই ছেলেটাকে ধমক লাগালো ফাল্গুনী। হালকা ধমক দেবার পর ছেলেটার কাচুমুচু চেহারা দেখে সে আর কিছু বললনা, জুতোটা দিতে বলল তাড়াতাড়ি। ছেলেটা কিছু না বলে তার জায়গায় বসলো, কপালের ঘাম এক হাত দিয়ে মুছে নিল। ফাল্গুনীর দিকে হালকা একটা করুণ চাহুনি দিলো। তারপর বলতে শুরু করলো “আফা! কাইল রাইতে আফনের জুতা নিয়া বাড়িত চইলা গেসিলাম, হেরপর ছাইড্ডা খাইয়াই আফনের জুতা সিলাইছি আফা! সিলাই দিয়া আমার বাক্সের কাছে রাইখা ঘুমাইয়া গেলাম । অহন সকালে উইট্টা দেহি আফা, আফনের জুতা জোড়া নাই। বিশ্বাস করেন আফা! হারা বস্তি খুইজা আফনের জুতা পাই নাই আফা! অহন আমি কি করুম আফা আফনেই কন, আফনের জুতা খুঁজতে গিয়াই দেরি হইলো, কিন্তু পাইলাম না আফা!”

এই বলেই ছেলেটা হাউমাউ করে কান্না আরম্ভ করলো ... এমনিতেই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে ফাল্গুনীর। তার উপর এইসব ন্যকা কান্না তার একদম পছন্দ না। ওদিকে মৃন্ময় এর সাথে দেখা করার সময় ও হয়ে গেলো। সাথে বেশী টাকা ও নেই যে আরেকটা জুতো কিনবে। এইদিকে ছেলেটাকে ও কি বলবে বুঝতে পারছে না ফাল্গুনী। ছেলেটা আবার বলল “আফা! বিশ্বাস করেন আফা! আমি সত্যিই আফনের জুতা সিলাইছিলাম। সেই সকাল থাইক্কা খুইজা খুইজা পাই নাই আফা! কি করুম অহন? সব দোষ আমার”।

এই বলেই ছেলেটা কান্নার শব্দ আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। ফাল্গুনী এখন চাইলেই ছেলেটার কালো চকচকে গালে কষে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিতে পারে। ছেলেটা যে অপরাধ করেছে, এতে থাপ্পড় দেয়াই যায়। কিন্তু এভাবে কাউকে থাপ্পড় দেবার পুর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ফাল্গুনী দিতে পারছে না। একটা জড়তা কাজ করছে তার মাঝে। ফাল্গুনী দিলো এক ধমক, “এই ব্যটা, জুতোর কি পাখা গজাইছে নাকি যে নিজে থেকে উড়াল দেবে ? চোরের ব্যটা চোর!” এইটুকু বলেই সে বুঝতে পারলো থাপ্পড় টা সে দিতে পারবে। জীবনের প্রথম থাপ্পড় একটা কালো চকচকে গালে বসিয়েই দিলো ফাল্গুনী। ছেলেটার দিকে আরেকবার তাকাল ফাল্গুনী। চোখে পানি, আর কপালের কয়েকটা ভাঁজে ভাঁজে ঘাম এর ফোঁটা চিক চিক করছে। ফাল্গুনী আর কিছু না বলে ঘুরে হাটা শুরু করলো। মুচি ছেলেটা গালে হাত দিয়ে আপনমনে হাসছে। সেইসাথে চোখে দুফোঁটা জল, সূর্যের হালকা আলো এসেছে পড়েছে তাতে। সেই চোখের জলের ফোঁটায় ভাসছে আগের রাতের কাহিনী ।


রইছ, বাবা রইছ, খানি লইছি, খাইবি আয়। মায়ের ডাকে জুতোর সেলাই তাড়াতাড়ি সেরে ফেলল রইছ। একজন আপু তাকে জুতোটা সেলাই করে রাখতে বলেছে। কাল সকাল সকাল নেবে। সে ও সেলাই করে ফেলেছে। হাত ধুয়ে খেতে বসলো সে। খাওয়া শেষ করে দেখল ওই আপুর জুতো টা তার মা পায়ে দিয়ে আছে। মায়ের পায়ে জুতোটা মানিয়েছে ও বেশ!

মা বলছে “এইডার মতন একখান জুতা আনিছ তো আমার লাইগা বাপ, ছোডবেলায় আব্বা আইনা দিত লাল লাল জুতা। আমার যা ভালা লাগতো! লাল জুতা পায়ে লাগাইতাম, আর হারা গেরাম ঘুইরা বেড়াইয়া মাইনষেরে আমার নতুন জুতা দেহাইতাম। অহন তো আর অইসব বয়স ও নাইরে বাপ! তা ও মাযে মাযে শখ হয় আর কি! কম দামে পাইলে আনিছ তো একখান! এইটুকু বলেই রইছের মা জুতো খুলতে যাচ্ছিলেন। রইছ বাঁধা দিলো। আরে মা! খুলো ক্যান? তোমার আব্বা অহন আমি না?

আমি তোমার লাইগাই এই জুতা আনছি। এক দোকানে কম দামের পাইয়া নিয়া আইছি। একটুখানি সিলাই করন লাগছে, এই আর কি! এইডা তোমার লাইগাই। পায়ে দিয়া রাখো। রইছের মা মমতা মাখা এক চিলতে হাসির সাথে রইছ কে বুকে জড়িয়ে নিলেন। উনি ছেলের উপর খুব খুশি। আবেগ মাখা হাসিতে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। রইছ মায়ের বুকে মুখ লুকালো, সাথে সত্যটা ও লুকিয়ে ফেললো। রাত বাড়ছে। বাঁপাশের খোলা জানালা দিয়ে একফালি আলো এসে পড়ছে মা ছেলের মুখে। সে আলোয় রইস বা তার মা কারো চোখের জলই কেউ দেখতে পাচ্ছে না। অনেকদিন পর আজ মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়েছে রইস। রইসের মায়ের খাওয়া হয়নি। পানি দেয়া ভাত আর পুঁইশাক ঢাকা দেয়া আছে। খিদা লাগলেও রইসের মাথা সরিয়ে উঠে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছেনা তার। দুজনের চোখেই টলটল করছে সুখের জল। শুধু জানালা দিয়ে একা চাঁদটাই মাঝেমাঝে উঁকি দিয়ে মনভরে দেখছে যেন মা ছেলের এই অব্যক্ত ভালবাসা ।

লেখক- চৌধুরী আদি

লাভ এ্যাট থার্ড সাইট

কেবল ৬.৩০ এত সকালে ভার্সিটিতে গেলে কাক পাখি ছাড়া আর কিছু মিলবে না খুব অস্থির লাগছে তার উপর সারা রাত ঘুম হয়নি আবিরের ।বার বার মায়াবতী কন্যার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। হলুদ শাড়িতে তাকে কাল অপূর্ব সুন্দরী লাগছিল। মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে হলুদ একটি পরী নেমে এসেছে তার সামনে। আর কপালের মাঝে লাল টিপ ইরার সৌন্দর্যকে যেন পূর্ণতা এনে দিয়েছিল।

-- কি রে ভাইয়া আজ এত তাড়াতাড়ি উঠলি যে? সূর্য কি আজ উল্টা দিক থেকে উঠল ?
= ধুর ! ফাজলামো করিস না তো
-- চেহারা দেখেতো মনে হচ্ছে সারা রাত ঘুমাস নাই! শরীর খারাপ করল নাকি ?
=আর ঘুম!অনেক নার্ভাস লাগছে ! ইরাকে গতকাল চিঠিটা দেওয়ার পর থেকে চিন্তায় আমার খাওয়া ঘুম হারাম হয়ে গেছে ! ও যদি রাগ করে? তুই ওর রাগ চিনিস না !

--আচ্ছা তুই আজকে তোর রহস্যের সমাধান কর তো। মেয়েটার সাথে তোর পরিচয় কিভাবে? ইরার প্রেমে পরলিই বা কিভাবে তাও তোর মত ছেলে যে কিনা কখন প্রেমে পরবে না। ব্যাপারটা একটু কেমন কেমন না? =কেমন কেমন না মানে কি। আমি কি রোবট নাকি? আমি কি ভালবাসতে পারি না? কি আজিব! --আরে না সেটা হবে কেন?

আগে তো সেরকমই ছিলি কখনো প্রেম করবি না। প্রেম করা মানে টাইম নষ্ট, এইটা সেইটা......তো এখন কি =ধুর ব্যাটা, তুই বেশি বুঝিস যাহ তোকে কিছু বলব না। --না না সরি ভাই, বল না আমি শুনতে চাই, আমি আর বেশি বুঝব না, কিছু বলব না তুই বল =আচ্ছা বলছি। ইরার সাথে আমার দেখা হওয়া কোন সিনেমা কিংবা গল্পের কাহিনীর মত নয়।

কয়েকজন বন্ধুর মাধ্যমে ওর সাথে আমার পরিচয়। আমরা একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তবে ভিন্ন ডিপার্টমেন্টে। আমাদের পরীক্ষার পর যখন ক্লাস শুরু হল সেদিন পড়ন্ত বিকেলে ওকে প্রথম দেখি। গল্প করছিল অরুন আর কয়েকজন বন্ধুর সাথে। ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সবাই কথা বলল। কিন্তু মেয়েটা আমার সাথে কথা বলা তো দূরের কথা তাকালোই না। মনে হল মেয়েটা ভাব নিচ্ছে।

তাই আর কিছু না বলে চলে এলাম। আরেকদিন অরুন আর কিছু বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলাম দেখি পাশে বসে একটি মেয়ের সাথে গল্প করছে আর খিলখিল করে হাসছে। এলোমেলো চুল হাওয়ায় উড়ছে আর ঠোঁটের কোণে টোল পরছে। মেয়েটাকে দেখে মনের মাঝে কেমন যেন একটু ভালোলাগা জন্ম নিল।

কিন্তু ভালোলাগা থেকে অভিমানের পরিমাণটা মনে হয় বেশিই ছিল তাই তো অভিমানের কাছে ভালোলাগাটা তেমন পাত্তা পেল না। যে দুইদিন ইরাকে দেখেছি বিশেষ ভাবে তেমন কিছুই মনে হয় নি। সবসময় সিম্পল সাদামাটাভাবে চলাফেরা করত, লম্বা চুলগুলো বেঁধে রাখত। কিন্তু একটি দিন আমার জীবনকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়। অরুনকে খুঁজতে এসে দেখি ইরা একটি মেয়ের সাথে বসে মোবাইল টিপছে।

যেহেতু ওর কাছে উত্তর পাওয়ার কোন আশা নেই তাই বাধ্য হয়ে ওর পাশে বসা মেয়েটিকেই জিজ্ঞেস করলামঃ =আচ্ছা অরুন কই জানো? --অরুন একটু বাইরে গিয়েছে। ওর আসতে একটু দেরী হবে! আমি অবাক হয়ে তাকাতেই দেখি ইরা আমার দিকে মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে।

অপ্রত্যাশিতভাবে ওর উত্তর পেয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আরো পাগল হয়ে গেলাম যখন ওর কাজল দিয়ে আঁকা চোখের দিকে তাকালাম। মানুষের চোখ এত সুন্দর হতে পারে আমি স্বপ্নেও ভাবি নি। আমি ওর চোখের দৃষ্টিতে আমার সর্বনাশ দেখছি। মনের মধ্যে আশ্চর্য রকমের ভালোলাগা কাজ করছে। ইরা লক্ষ্য করেছে কিনা জানি না আমি পুরো একটি ঘণ্টা চুপিচুপি ওর চোখ আর হাসির দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

মনে হচ্ছিলো আমার পাশে এক মায়াবতী কন্যা বসে আছে যার চোখে আর হাসিতে মায়ার আলো বেয়ে পড়ছে। তারপর.........এই দাড়া এক মিনিট,গল্পের মাঝপথে থামিয়ে দিল সৌরভ --ভাইয়া মায়ার আলো কিরে? জীবনেও তো শুনি নাই। =এসব বুঝবি না তুই শোন তো --আচ্ছা বল সারাক্ষণ মেয়েটার কথা ভাবলাম। নাহ ইরাকে ছাড়া থাকা সম্ভব হবে না। ওকে বলতে হবে।

কিন্তু পরে আবার ভাবলাম এভাবে বললে মনে করবে আমি ভালো ছেলে না উল্টো আরও কথা শুনতে হবে। পরে অনেক ভেবেচিন্তে উপায় বের করলাম। ফেসবুকে ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। অরুনের বদৌলতে ওর নামটা জানা ছিল। ইরা লিখে সার্চ দিলাম। অনেকক্ষন খুঁজাখুঁজির পর আমার সেই মায়াবতীর চেহারাটা দেখতে পেলাম।

মনে হল খুশিতে পাগল হয়ে যাই। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিলাম। কেন জানি মনের মধ্যে বিশ্বাস ছিল ইরা আমার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করবে। কিন্তু যখন দেখলাম সকাল পার হয়ে, দুপুর গড়িয়ে রাত হয়ে গেল কিন্তু ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে নি তখন আমার বিশ্বাস ফিকে হয়ে এল। মন এত খারাপ হল যে বলার মত নয়। মন খারাপ নিয়েই ঘুমিয়ে পরলাম।

সকালে উঠে যথারীতি ফেসবুকে গিয়ে দেখি ইরা রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করেছে। খুশিতে আমার শূণ্যে ভাসার মত অবস্থা। । ওর প্রোফাইলে গিয়ে দেখি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছে- " I am in an imaginary relationship and its complicated." স্ট্যাটাসটা দেখে মজা লাগল। ইরা মনে হয় আমার মতই পাগল।

এভাবে হাসিখুশিতে পুরোদিনটা পার করলাম। রাতে ফেসবুকে গিয়ে দেখি ইরার নামটা চ্যাট লিস্টে দেখাচ্ছে। বুকটা ধক করে উঠলো। নক করব কি করব না ভাবতে ভাবতে এক সময় দেখি মনের অজান্তেই "হাই" লিখে নক করে বসে আসি। কিছুক্ষন পর রিপ্লাই এলো --হাই। =কেমন আছো?
--এইত ভালো। তুই? =আমিও ভাল। --আচ্ছা শোন তুই যেহেতু আমার ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড সেহেতু তুই আমারও ফ্রেন্ড তাই এত ফর্মালিটি দেখাতে পারব না।

তুই করেই শুরু করলাম। আশা করি মাইন্ড করিস নি। =না না মাইন্ড করার কি আছ!!! --তাহলে তো ভালই। আচ্ছা কি করিস? =চ্যাট করি। তুই? --আমি ভাবি =তুই আবার ভাবিস নাকি? --আজকে থেকে তো আমাদের ফ্রেন্ডশিপ শুরু হল। সময় হলে দেখবি আমি কত ভাবতে পারি! কোন মেয়ে কাওকে এত জলদি আপন করে নিতে পারে এই প্রথম দেখলাম।

এভাবেই আস্তে আস্তে আমাদের কথা বলা শুরু হয়। আমি আসলেই ভুল ছিলাম ভাবতাম যে মেয়েটা অনেক ভাব নেয়। কিন্তু সেরকম কিছুই না। তবে মেয়েটা অনেক মজার। সবসময় দার্শনিক টাইপের স্ট্যাটাস দিত। স্ট্যাটাসগুলো এত সুন্দর যে বলার বাইরে।

ইরার একটি স্ট্যাটাস আমার সবচেয়ে প্রিয়- "তোমার সাথে আমি কখনও নামীদামি রেস্টুরেন্টে যেতে চাই না বরং পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদের আলোয়ে তোমার হাত ধরে হাঁটতে চাই। ভালোবাসা দিবসে তোমার কাছ থেকে আমি হীরের আংটি চাই না, শুধু কয়েক গাছি লাল চুড়ি আর একটি লাল গোলাপ চাই। আমি তোমার কাছে কখন সুন্দর উপহার চাই না, তবে আমার খোপায় জড়িয়ে দেয়ার জন্য বেলিফুলের মালা আমার চাই।"

ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে দূরত্ব কমে আসে। আমরা অনেক ভাল বন্ধু হয়ে যাই। মনের যত কথা আছে ওর কাছে না বললে আমার শান্তি লাগেই না। ইরা আর আমি যখন একসাথে হই তখন আমাদের খুনসুটি দেখে কে! একদিন পাগলীটা আমার উপর এতই রাগ করল যে আমার খাতার সব পৃষ্ঠা ছিঁড়ে এতোগুলো নৌকা বানিয়ে ফেললো। আমি ওর নৌকাগুলো অনেক যত্ন করে রেখে দিয়েছি।

একটুও নষ্ট হতে দেই নি। জানিস সৌরভ যতদিন যাচ্ছে আমি মেয়েটাকে আরও ভালবেসে ফেলছি। ওকে ছাড়া থাকা এখন আমার জন্য অসম্ভব ব্যাপার। --তুই ইরাকে এত ভালবাসিস? =হুমম --তো বলে দিস না কেন? =আরে গাধা চিঠিতে তো সেইটাই লিখেছি! -- শেষ পর্যন্ত চিঠি? ! = কি করব বল ?! মেয়েটার রাগটাকেই যত ভয় আর কিছু না।

হঠাৎ ঘড়ির দিক চোখ পড়তেই লাফিয়ে উঠে আবির! ৯টা বেজে গেছে! ভাইয়ের সাথে কথা না বাড়িয়ে কোন রকমে পাঞ্জাবিটা গায়ে জড়িয়ে বেড়িয়ে পড়ল! গতকাল ভার্সিটি শেষে ইরার হাতে খামটা দিয়েই দৌড়ে চলে আসছিল । ইরা অনেক বার ডাকলেও পিছনে ফিরে তাকায় নি ! এদিকে আবিরের কাছ থেকে এরকম একটা খাম পেয়ে ইরা কিছুটা অবাক । ছেলেটা আসলেই একটা পাগল! কখন যে কি করে বসে না ?!

খামটা খোলার জন্য উৎসুক মন নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরল ইরা । বাসায় ফিরেই সব কাজ বাদ দিয়ে আগে খামটা খুলতেই ভিতরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা একটি চিঠি আর একটি নৌকা আবিষ্কার করল

“প্রিয় মায়াবতী কন্যা, তোর ওই ভয়ংকর রাগের কথা ভেবে একটা কথা অনেক দিন থেকে বলার সাহস হয়ে উঠেনি। তাই চিঠির আশ্রয় নিলাম। মানুষ সবসময় লাভ এ্যাট ফাস্ট সাই্টের কথা বলে, কিন্তু আমার সাথে ঘটেছে পুরোপুরি উল্টো ঘটনা। জানিস যেদিন আমি তোকে প্রথম দেখি আমার মনে হয়েছিল তুই অনেক ভাব নিস।

তবে তৃতীয় বার দেখার পর তোর কাজল টানা মায়াবি চোখ আর গালের ওই সুন্দর টোলের প্রেমে পড়ে গিয়েছি। ধীরে ধীরে যখন তোর সাথে আপন হতে শুরু করলাম তখন বুঝলাম আমার ধারনা ভুল । বরং মানুষকে আপন করে নেয়ার অপূর্ব ক্ষমতা তোর মাঝে দেখে আমি অবাক হয়েছি। তোর কি মনে আছে সেই নৌকাগুলোর কথা? যেগুলো আমার খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে বানিয়েছিলি? আমি সেগুলো আজও যত্ন করে রেখে দিয়েছি।

আচ্ছা তুই তোর নৌকায় আমাকে একটু ঠাই দিবি? জীবনের আর একটি নতুন বসন্তের শুরুতে ভাবনার অতীত রূপকথার রাজকন্যা ও কাঠুরিয়ার গল্পের মত অসম্ভব কিছুর প্রত্যাশায় থাকব.................” আজ ভালবাসা দিবস। আবিরদের ভার্সিটিতে চারিদিকে আজ লাল রঙটির সমারোহ। যে যার নিজের মত করে দিনটিকে বরণ করে নিচ্ছে ।

যেখানে ইরার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল আবির সেখানে দাড়িয়ে তার মায়াবতীকে খুঁজছে আর সাত-পাঁচ ভাবছে,জীবনের ২৪তম বসন্তটাকে সে কি একটু অন্যভাবে পাবে? পিছন থেকে হঠাত ইরার ডাকে তার ভাবনায় ছেদ পড়ল... আবির চোখ ফেরাতে পারছিল না তার মায়াবতী কন্যা যে লাল অপ্সরী সেজে তার সামনে দাড়িয়ে আছে………..

-- ওই এইখানে ষাঁড়ের মত দাড়িয়ে আছিস কেন? = কিছু না এমনিই !!! -- এরকম গাধার মত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে কি দেখিস? =কই তাকিয়ে আছি। তুই না বেশি বুঝিস ! --হুম আমি তো বেশিই বুঝি! আচ্ছা ,চিঠির শেষে কি হয় তা কিন্তু তুই লিখিস নাই =অতঃপর রাজকন্যা ও কাঠুরিয়া একত্রে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল !! -- হুম অসম্ভব প্রত্যাশা!!! আবিরের খুব কষ্ট হচ্ছে।

ইরার সামনে থাকার মত শক্তিটুকু তার নাই এখন = আমি একটু ওই দিকটা দেখে আসি বলেই আবির ইরার জন্য আনা দুটো গোলাপ তাকে না দিয়েই চলে আসল ক্যাম্পাসের বড় শিমুল গাছটার নিচে । খুব কান্না পাচ্ছে আবিরের। হঠাত আবির তার হাতের মাঝে কোমল স্পর্শ অনুভব করল । হ্যাঁ ! তার মায়াবতী কন্যা তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। -আচ্ছা গোলাপ দুটো কি হাতে রাখবে নাকি আমাকে দিবে? -মানে? -মানে কি? গোলাপফুল কি অন্যকারো জন্য? আমাকে চিঠি লিখে অন্যকারো জন্য গোলাপফুল? আবিরের মুখে হাসি।

পরমভাবে চাওয়ার কিছু পেয়ে গেলে মানুষের চোখ যেভাবে খুশীতে ভিজে তারও ভিজে উঠল। আচ্ছা আবিরেরর মত করে কি ইরাও কাঁদছে!? কাদলে, কাঁদুক না ! তাদের দুজনের ভালবাসা মিশে এক হয়ে যাক অশ্রু জলের প্রতিটি কণায় আর তাদের অনুভূতি জেগে থাক রাতের বুকে জেগে থাকা চাঁদের মত করে । কারণ কিছু ভালবাসা প্রকাশের প্রয়োজন পড়ে না অনুভূতিই তাদের মাঝে কথা বলে !

লেখক: তাসনিম হক মুনা

অসমাপ্ত ভালোবাসার নীল গোলাপ

দেরীতে ঘুম থেকে ওঠাটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। প্রতিদিন ১০টায় আমার সকাল হয়। আর বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে ১১টা বেজে যায়।

আজ হঠাত কোন এক কংসমামা আমার সুখের সংসারে আগুন ধরিরে দিল। দিব্যি ঘুমাচ্ছিলাম। সকাল ৭টা থেকে লোকটা আমার দরজায় এসে অবিরাম কড়া নেড়ে যাচ্ছে। আধাঘণ্টা পার হয়ে গেলো তবুও লোকটি ক্লান্ত হল না। তিনি রবার্ট ক্লাইভের নীতি মেনে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

অবশেষে যখন ১ ঘন্টা পার হবার উপক্রম তখন আমার বোধদয় হল। বুঝতে পারলাম নিশ্চই গুরুত্বর কিছু হয়েছে। হয়ত বাইরে পুলিশ এসেছে নয়ত অন্য কোন দুঃসংবাদ। যাক, চিন্তা ভাবনার সময় আর দীর্ঘস্থায়ী না করে ধীরে ধীরে গিয়ে দরজা খুললাম।

- শুভ সকাল। কথাটা খুব হাসিমুখেই বললেন তিনি। অথচ তার উচিৎ ছিল দরজা খোলার সাথে সাথে আমার গণ্ডদেশের অবস্থান নির্ণয়পূর্বক সেখানে একটা কম্পনের সৃষ্টি করা, যা প্রথমে শব্দের সঞ্চার করবে তারপর আস্তে আস্তে আগুনের মত লাল বর্ণ হবে। লোকটা ধৈর্যশীলতার তারিফ না করে পারা যায় না। কারন তিনি এমন কিছুই করলেন না। এমনকি তার মুখের বিরক্তির ছাপটুকুও নেই।

লোকটা আমার দিকে একটা ডায়েরি এগিয়ে দিলেন। কেউ কোন কিছু ফ্রীতে দিলে আমি অকারণেই খুশি হই, এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। কিন্তু আমার আনন্দভরা মুখ মুহূর্তেই ম্লান হয়ে গেলো যখন দেখলাম ডায়েরীটা পুরনো।

লোকটা বলল," এটা আপনাকে একজন পাঠিয়েছেন। অনেক কষ্টে আপনার ঠিকানা খুঁজে বের করেছি। আমি এখন আসি।"

আসি বলেই লোকটা চলে গেলো।

আমি ডায়েরীটা বিছানার ওপর রেখে নাস্তা করতে গেলাম। আমি ব্যাচেলর মানুষ। অফিসের জন্য রেডি হয়ে বের হই আর পথিমধ্যে নাস্তা করে নিই। রাতে অফিস থেকে বাসায় ফিরলাম। এর মধ্যে ডায়েরীটা কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বাসায় এসে দেখি ডায়েরীটা বিছনার ওপরই আছে। হাতমুখ ধুয়ে এসে ডায়েরীটা খুললাম।

০২/০১/২০১২
আমি নূপুর। মা'এর দেওয়া নাম। ছোটবেলা থেকেই আমি ডায়েরী লিখতাম। ডায়েরী লিখতে আমার খুব ভাল লাগতো। আমি আমার সব আনন্দের মুহূর্তগুলো ডায়েরীর পাতায় বন্দী করে রাখতাম। যখন দুঃখ-কষ্ট এসে আমাকে গ্রাস করার চেষ্টা করত তখন ডায়েরীর পাতায় চোখ বুলাতাম। এগুলো আমায় আনন্দ দিতো।

অনেকদিন থেকে ডায়েরী লেখা বাদ দিয়েছি। আজ আবার লিখতে বসেছি। কারন এই ডায়েরীটা আমাকে আমার খুব কাছের বন্ধু দিয়েছে। ওর নাম নীল। আমি ওকে নীলু বলে ডাকি। ওর জন্য আমার ডায়েরী লেখার নেশাটা আবার শুরু হল। ধন্যবাদ তোমাকে বন্ধু।

১৪/০২/২০১২
আজ ভালোবাসা দিবস। দিনটা আমার জন্য খুব স্পেশাল। আজ ও আমাকে ৫টা নীল গোলাপ দিয়েছে। আমি আজ অনেক খুশি। আমার মত খুশি আজ পৃথিবীতে কেউ নেই। না চাইতেই আমি অনেক বড় একটা জিনিস পেয়েছি, এটা আমি হারাতে চাই না। ও ওর নামি তো বলা হল না। ওর নাম কবির। সবাইকে একটু আলাদা নামে ডাকতে আমার খুব ভালো লাগে। ওকেও আমি অন্য নামে ডাকি। কবি বলে। কিন্তু ও আবার কবিতা লিখতে পারে না।

নীল অনেক সুন্দর কবিতা লেখে। এসব ও ওর ডায়েরীতে লেখে কিন্তু আমাকে কোনদিন পড়তে দেয় নি। আমি ওর এত ভালো বন্ধু আর ও আমার কাছেই লুকায়। একবার জোর করেছিলাম বলে ও আমার জন্য প্রতিদিন কবিতা লিখে নিয়ে আসতো। কিন্তু ওসব ওর ডায়েরীর কবিতা ছিল না। আজ আমার এত স্পেশাল একটা দিন গেলো অথচ আজ নীলের সাথেই দেখা হল না। ওকে কতবার যে ফোন দিলাম, ধরলো না।

১৭/০৪/২০১৩
আজ আমাদের রিলেশনের ১ বছর হয়ে গেলো। ভেবেছিলাম সারা জীবন এভাবেই কাটিয়ে দেবো, বিয়ে করব না। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর পারলাম না। বাসায় আমার বিয়ের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। আমার পক্ষে সব কিছু সাম্যাবস্থায় রাখা মুশকিল হয়ে পরছিল। কবি'কে বার বার বললাম, চল, পালিয়ে বিয়ে করি। কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হয় না।

১০/০৫/২০১৩
শেষপর্যন্ত আমাদের পালিয়েই বিয়ে করতে হল। নীল আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে। বিয়ের পর ট্রেনে তুলে দেওয়া পর্যন্ত ও আমাদের সাথেই ছিল। ট্রেনে ওঠার সময় যখন ওর কাছ থেকে বিদায় নিব তখন পিছু ফিরে দেখি ও নেই। এমন তো ওর করার কথা নয়। হয়ত আমি চলে যাচ্ছি বলে ওর খারাপ লাগছে। ট্রেন যখন ছেড়ে দিলো তখন দেখলাম ও দৌড়ে এসে আমার হাতে একটা ডায়েরী এগিয়ে দিলো। সেদিন আমি ওর চোখে জল দেখতে পেয়েছিলাম কিন্তু জিজ্ঞেস করার আগেই ট্রেনটা ছেড়ে দিলো।

১৪/০৩/২০১৪
কবি কেমন যেন পালটে গেছে। আগের মত আর নেই। আমার সাথে আর ভালো করে কথা বলে না। অকারণে আমার সাথে ঝগড়া করে। কিন্তু তবু আমি ওকে ভালবাসি।

আজ বিয়ের এক বছরের মত পেরিয়ে গেলো। ভেবেছিলাম বাসা থেকে সবাই মেনে নিবে কিন্তু তেমনটা হল না। নীল অনেক চেষ্টা করেছিল বাসায় বুঝানোর কিন্তু ওরা ওকে অনেক অপমান করেছে। বেচারা নীলের জন্য খুব খারাপ লাগছে!

২৮/০৪/২০১৪
কবি'র ব্যবহার দিন দিন পশুর মত হয়ে যাচ্ছে। আজ ও নেশা করে বাড়ি ফিরেছে। নেশার ঘোরে আমাকে বলেছে ও নাকি আমাকে বিয়ে করে কিছুই পায় নি। আমি তো ওকে ভালোবাসা ছাড়া কিছুই দিতে পারব না। আর বিয়ের আগে ও তো শুধু আমার ভালোবাসাই চেয়েছিল। এখন তাহলে কি হল!

আজ আর ঘুম আসছে না। খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছে। ব্যাগের ভেতর থেকে কাপড় বের করতে গিয়ে হঠাত নীলের দেওয়া ডায়েরীটা চোখে পড়লো। বুঝতে পারলাম এটা ওর সেই কবিতা লেখার ডায়েরীটা। মন ভালো হয়ে যাবে ভেবে ডায়েরীটা পড়তে শুরু করলাম।

ডায়েরীর প্রথম পাতায় ছিল শুকিয়ে কয়েকটা গোলাপের পাপড়ি। নিচে লেখা, "আজ ওকে আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছিলাম। ওর জন্য একটা নীল গোলাপ কিনেছি ওকে দেবো বলে। কিন্তু দূর থেকে দেখতে পেলাম ওর এক হাতে পাঁচটা নীল গোলাপ আর এক হাত ধরে আছে কবির। দুইজন লেকের ধার দিয়ে হাঁটছে আর হাসাহাসি করছে।

নূপুর আমাকে কেন বলে নি ও কবিরকে ভালোবাসে। ওর প্রেমে পড়ার অনুভূতিগুলো যখন আমাকে বলতো তখন ভাবতাম ও আমার জন্য এসব অনুভব করে। আজ বুঝলাম সেগুলো কবির'এর জন্য। হাহাহা...। আমি কত বোকা।

নূপুর আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, আর আমি ওকে কষ্ট দিতে চাই না। তাই ওর সাথে দেখা না করেই চলে আসি। ভালোবাসা অনেক নিষ্ঠুর, কাউকে হাসায় আবার কাউকে কান্নার সাগরে ভাসিয়ে দেয়। ডায়েরীতে লেখা কবিতাগুলো আমি ছিঁড়ে ফেলেছি। যার জন্য এসব লিখেছি সেই এখন অন্য কবির কবিতার লাইন হয়ে গেছে।"

নীলের ডায়েরীটা পরে অবাক হয়ে যাই আমি। ও আমাকে ভালোবাসতো অথচ আমি কখন বুঝতেই পারি নি। তাহলে রাত জেগে আমার জন্য নোট করে দেওয়া, অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও আমার জন্য কলেজে আসা, রাস্তার ছেলেদের সাথে মারামারি করা, পরীক্ষার সময় নিজে না ঘুমিয়ে আমাকে ভোর বেলা ডেকে তুলে দেওয়া- এসবের কারণ কি তাহলে এটাই ছিল?

আমি হয়ত বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছি। দোষটা নীলেরই। ও বলতে দেরি করায় কবির সে জায়গা দখল করে নিয়েছে। আর আমি ওকে আমার প্রিয় বন্ধুর জায়গাতেই রেখেছি।

ডায়েরীর মাঝের পাতায় আর কিছু লেখা নেই। শেষের দিকে লেখা, "বুকে পাথর দিয়ে কষ্টগুলো চেপে রেখেছি। কাল ওরা বিয়ে করছে। আমি চাই নি এই মুহূর্তটার সম্মুখীন আমি হই। কিন্তু নূপুর আমাকে থাকতে বলেছে। তাই কষ্ট হলেও আমাকে ওদের সাথে থাকতে হবে।

কালকের পর হয়ত নুপুরের সাথে আর দেখা হবে না। বুকের ভেতরটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কিন্তু আমি ওদের ভালোবাসায় কাঁটা হতে চাই না। ভালো থেকো, নূপুর। সুখে থেকো।"

২৯/০৪/২০১৪
আজ কেন জানি নীলের কথা খুব মনে পড়ছে। কবিরকে বললাম, চল, নীলের সাথে দেখা করে আসি। ও তো আমাদের অনেক উপকার করেছে। কবির আমার ওপর রেগে গেলো। আমাকে যা নয় তাই বলে গালি-গালাজ করল। যখন আমার বাবা-মা'কে নিয়ে খারাপ কথা বলতে শুরু করল, আমি চুপ করে থাকতে পারলাম না। প্রতিবাদ করি আর সেটাই আমার অন্যায় হয়ে যায়। ও আমার ওপর হাত তুলল, শুধু তাই নয় আমাকে টেনে-হিঁচড়ে বাড়ির বাইরে বের করে দিলো। সারারাত আমি বাইরে বসে কাটালাম।

আমি কবিরকে অনেক ভালোবাসি। এখনও ভালোবাসি। আমি জানি, ও ওর ভুল ঠিক বুঝতে পারবে। ডায়েরীতে আর কিছু লেখা ছিল না। শেষের পাতায় একটা চিরকুট দেখতে পেলাম। লেখাগুলো অন্য রকম, নুপুরের হাতের লেখার মত নয়।

"নূপুর এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। ওর অবস্থা খুবই খারাপ। আজকের রাতটা ও পার করতে পারবে কি না তা নিয়ে ডাক্তাররা সন্দিহান। চলে যাবার আগে ও একটি বার তোমার সাথে দেখা করতে চায়। নিচে ঠিকানা দেওয়া আছে, পারলে একটি বার এসে দেখে যেও।"

আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। চারিদিক কেমন অচেনা লাগছে। মাথা ঝিম মেরে আসছে। কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাত ফোন বেজে উঠলো,

-হ্যালো, নীল সাহেব বলছেন??
- জী, বলছি।
- আপনি একটু তাড়াতাড়ি আমাদের হাসপাতালে চলে আসুন। নূপুরের ম্যাডামের অবস্থা ভালো না।

ফোনটা কেটে দিয়ে তাড়াতাড়ি করে বের হলাম। বাসার দারোওয়ান আমাকে দেখে বলল যে সকালে এক লোক নাকি আমার ফোন নাম্বার নিয়ে গেছে। আমি আর দেরি করলাম না, তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে গেলাম। হাসপাতালে ঢোকার সময় দেখি একজন লোককে তিনজন পুলিশ হাতকড়া লাগিয়ে গাড়িতে তুলছেন।

চিনতে খুব একটা কষ্ট হল না যে এই সেই কবির। জানতে পারলাম, প্রতিদিন নেশা করে এসে নূপুরের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাত সে। বার বার বলতো বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে কিন্তু নূপুরের সাথে ওর বাবা-মা সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তাই ওকে প্রতিদিন এসব অকথ্য নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হত।

কয়েকদিন আগে সে নাকি নুপুরকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অল্পের জন্য বেঁচে গেলো নূপুর এখন মৃতপ্রায় অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় পরে আছে।

নূপুরের কাছে গেলাম। ওকে দেখে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করল। এতদিন পর আজ নুপুরকে সামনে পেয়েও খুশি হতে পারছি না। কিছু
কিছু হারানো জিনিস খুঁজে পেলে যে সেটা অপরিসীম কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা আজ বুঝতে পারছি।

নূপুর আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। ও কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু বলতে পারছে না। শুধু চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।
আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে ওর হাত স্পর্শ করলাম। ওর হাত বরফের মত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

কাঁপা কাঁপা গলায় নূপুর আমাকে বলল,"আমাকে মাফ করে দাও।"

কথাটা শুনে আমি কেঁদে ফেললাম। অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কষ্টের পরিমান এতটাই বেশি যে সেগুলো আমার মুখের কথাকে আটকে রেখেছে।

নূপুরের দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে, ওর চোখের পাতা নড়ছে না। নূপুরের মুঠো করা হাত আমি ধরে রেখেছি। ওর হাতের ভেতর
গোলাপ ফুলের কয়েকটি শুকনো পাঁপড়ি।

আলো ছায়ার খেলা

জ্ঞান ফিরে আসতেই ফের হাসপাতালের কটু গন্ধটা নাকে লাগল । কেমন বিচ্ছিরি একটা গন্ধ ! মুক্তভাবে শ্বাসও নেয়া যায় না । বেশ কয়েকদিন যাবত এরকম অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে । ক’বার জ্ঞান হারিয়েছি খেয়াল নেই। ৩-৪ বার হবে হয়ত । কখন ঘুমিয়ে থাকি আর কখন জ্ঞান থাকেনা এখন আর আমার বোধগম্য হয়না । অনুমানের ওপর বের করা ।

আজকাল ঠিক তেমন কিছু চিন্তাও করতে পারিনা । পুরনো কিছু স্মৃতি মনে পড়ে অগোচরে । তবে তেমন একটা না । অনেক চাপ পড়ে মস্তিস্কে । মাথাটা বেশ যন্ত্রণা করছে । আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করলাম । দপ করে চোখে আলো লেগে মস্তিষ্কের সাথে লড়াই শুরু করে দিল। এ জগতে লড়াই বাদে কিছু নেই। যুদ্ধেও যেমন লড়াই আছে , প্রিয়তমার ভালবাসাতেও লড়াই আছে। পার্থক্য একটাই, একেকটার ধরন আলাদা ।

বা’ পাশ থেকে কথা বলার শব্দ শোনা যাচ্ছে । ভলিউম স্কেল আপ ডাউন করছে । নিশ্চয়ই মিষ্টি হবে । মেয়েটা এভাবে কথা বলে । তার উপর মেয়েটার একা কথা বলার বাতিক আছে । চুপচাপ থাকতে পারেনা । ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ যে কোন বিষয়ে সে একাই নিজের সাথে কথা বলে শেষ করে ফেলবে । তার উচিৎ ছিল বিতার্কিক হওয়া । তবে উচিৎ অনুচিত বিষয়টা ক’জন ভাবে !

আমি জেগে আছি বুঝতে পারলে হুলস্থুর কাণ্ড শুরু করে দিত হয়ত আবারো । ডাক্তার ডেকে এনে আমার অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া , নার্সকে ডেকে মেডিসিনের সময় জিগ্যেস করা, কিছুক্ষণ পর পর এটা খেতে দেয়া ওটা খেতে দেয়া , বার বার জিগ্যেস করা কেমন লাগছে এখন , কিছু লাগবে কিনা !

মিষ্টি অনেক কথা বলে । আমার সাথে যতক্ষণ থাকবে ননস্টপ কথা বলেই যাবে । আমি কথা বলি না বলি সমস্যা নেই , কিন্তু সে বলবে । এত কথা সে কোথায় পায় শুধু সেই জানে । হাসপাতালে আসার পর থেকে শুধু আমার বিষয়েই কথা বলছে । বাবা বলেছে নিশ্চয়ই ! তা না হলে তার জানার কথা না । সে যখন কথা বলবে তখন আমার জন্য অলিখিত নিয়ম হচ্ছে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে আর কথায় কথায় হু হাঁ করা বাধ্যতামুলক ।

তবে এখানে হু হা না করলেও তাকিয়ে থাকি তার দিকে । তার চোখের দিকে । অসম্ভব মায়াবি তার চোখযুগল । মনে হয় যেন বিধাতা অনেক সময় নিয়ে নিপুন কারুকার্যে সাজিয়ে তুলেছেন তার চোখদুটো । গভীরতা আছে অনেক । সেই গভীরতায় হারিয়ে যেতে আমার কোনও দ্বিধা নেই । মিষ্টির একটা গুন যেটা আমার কাছে ভাল লাগে তা হচ্ছে সে আমাকে কখনই একা অনুভব হতে দেয়না । সেটা যেভাবেই হোক । সেই প্রথম দিন থেকে শুরু করে আজ অবধি ।

মা ছোট বেলায় মারা যাবার পর থেকে বাবার হাত ধরে আমার পথচলা । মায়ের আদর তেমন একটা না পেলেও বাবার অঢেল স্নেহ পেয়েছি। বাবা আমার এবং আমি বাবার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন । আমরা একে অন্যের সবচেয়ে ভালবন্ধু । বন্ধুর মতই সব কিছু শেয়ার করি একে অন্যকে । সারাদিন কে কি করলাম রাতের খাবারের টেবিলে এ নিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠতাম ।

সবচেয়ে বেশি মজা হত আমার বন্ধুদের নিয়ে আলোচনায়। সেদিনের একটা ঘটনা , ক্লাসের এক বন্ধুর সাথে বাজি ধরেছি যে ক্লাসের সবচেয়ে নিরীহ ছেলেটাকে কোনো কারন ছাড়াই চড় মারব । তো কথা মত ছেলেটার সামনে গেলাম। মায়া লাগল তার চেহারা দেখে । তারপরও যেহেতু বাজিতে জিততে হবে তাই ছেলেটাকে বললাম দেখ ভাই, বাজি লাগছি । এখন তুই কো-অপারেট করলে আস্তে মারব আর সাথে বাজির ৫০% টাকা তোর ।

আর যদি কো-অপারেট না করিস , চিল্লাচিল্লি করিস, তো কিছুই পাবিনা সাথে জোরে একটা চর খাবি । সহজসরল চেহারার ছেলেটার চোখে পানি জমতে দেখেছিলাম । ছেলেটার চোখ ছলছল করছিল । বাজি হেরেছিলাম তাও ছেলেটাকে মারিনি। বাবা শুনে হেসেছিল আর বলেছিল আমার ২য় কাজের জন্য তিনি গর্বিত । তবে ১ম কাজের জন্য বিরক্ত। টাকার দরকার পড়লে এইসব কাজ যাতে না করি ।

বাবার এই কথার রেশ ধরেই মাঝে মধ্যে বাবাকে বিরক্ত করতে মজা পেতাম । কিন্তু মনে হয়না বাবা কখনও বিরক্ত বোধ করেছেন । যদি কখনও এমন হয়েছে পকেটে টাকা নেই , তো সোজা বাবার অফিসে চলে যেতাম । কাজে ব্যস্ত থাকুক না থাকুক সোজা রুমে ঢুকে বলতাম 'পকেটে টাকা নাই, টাকা দাও। না দিলে অফিসে আজকে ধর্মঘট' । বাবা হাসতেন , তার চেয়ারটায় বসতে দিতেন বলতেন স্যার কিছু খাবেন কিনা ! কখনও খেতাম কখনও খেতাম না । হাসি মুখে টাকা দিয়ে দিতেন আর বলতেন স্যার সময় পেলেই আবার আসবেন ।

মাঝে মধ্যে ঘুরতে চলে যেতাম বাপ বেটা মিলে । আমাদের অসংখ্য ছবি আছে ট্যুরের । ছবি দেখলে মনে হত মা পাশে থাকলে হয়ত জীবনটা অন্য রকম হতে পারত । তবুও আফসোস নেই । বিধাতার হিসাব এবং তার বান্দার হিসাব মিলেনা কখনও । এমন কখনও যদি হয়েছে যে আমি কখনও কোনও মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে আছি তাহলেও তা বাবাকে জানাতাম । আমাদের খুনসুটি গুলো শুনে বাবা হাসতেন, মজা পেতেন। আমার বিষয় ছিল আমি আর যাই করি বাবাকে জানিয়ে করব এবং তার নামে কখনও কলংক আসতে দিবনা আমার জন্য ।

ডাক্তার এসে দেখে গেল । কেমন লাগছে জিগ্যেস করতেই হেসে বললাম , এখন একটু ভাল লাগছে । তবে পাশে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটা যে হারে কথা বলে মনে হয় কোন না কোন দিন কানের তালা চাবি ছাড়াই খুলে যাবে । মিষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটা হাসছে । অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে মেয়েটা রাগেনি ।

আগে কখনও কিছু বললে অভিমানি হয়ে যেত , গোমড়া মুখে বসে থাকত । তারপর কখনও স্যরি বললে এক গাল হেসে তার রাজ্যের কথার ভাণ্ডার খুলে বসত । ডাক্তার বলল , ‘আপনি খুবই ভাগ্যবান যে এরকম একটা মানুষ আপনি পেয়েছেন। সারাটাক্ষণ আপনার পাশে পাশে থাকে । একটা মুহূর্তও আপনাকে তার চোখের আরাল হতে দেয়না। ’

মুচকি হাসলাম । দরজার ওপারে দেখলাম বাবা দাড়িয়ে আছেন । চোখটা ছলছল করছে উনার । আমি তাকিয়েছি দেখে অন্যদিকে ফিরে তাকালেন । আচ্ছা বাবা কি কাঁদছে ? বাবাকে কখনও কাঁদতে দেখিনি। আচ্ছা বাবা কাঁদছে কেন ? ডাক্তারকে জিগ্যেস করলাম , আমার অসুখটা কি ? মাথা এত যন্ত্রনা করে কেন ? ডাক্তার বলল , ‘ তেমন বড় কিছু না ।

ঠিক হয়ে যাবে ।’ আমার মনে হল ডাক্তার কিছু লুকালো আমার কাছে । এতটুকু বোধশক্তি তো আমার আছেই এটা বুঝার জন্য ! পাশে তাকিয়ে দেখলাম মিষ্টি জানালার ধারে দাড়িয়ে উদাস ভঙ্গিতে বাইরে তাকিয়ে আছে । সেও কি কাঁদছে ? বোঝা যাচ্ছে না । অন্তরের ক্রন্দন বড় বেশি কষ্টের ।

বহুদিন হয়ে গেছে বন্ধু আর এলাকার ভাইদের সাথে দেখা হয়না । তাদের কাছে আমার পরিচিতি অনেকটা বিশেষ ধরনের। “আমার সারাজীবনে প্রেমের আনাগনা এতই বেশি ছিল যে একলা থাকার সময় পাইনি” আমার অতি প্রচলিত উক্তিটা তারা এখন নিজেদের জীবনে ফলাতে চেষ্টা চালাচ্ছে । ফলাফল ? বোতল ছাড়া দেবদাস !একাই থেকে যাচ্ছে । বিষয়টা হাস্যকরই বটে ।

একটা বিষয়ে বরাবরই বন্ধু এবং ভাইদের সাথে আমার তর্ক লাগত । বিষয়টা হচ্ছে প্রেম এবং ভালবাসার ভিন্নতা । প্রেম হচ্ছে বহুমুখী । যে কেউ সময়ে অসময়ে যার তার প্রেমে পড়তে পারে । বিষয়টা হচ্ছে মোহের মত। মোহ কেটে গেলে যেমন আকর্ষণ কমে যায় ঠিক তেমনই একটা সময় গেলে সেই প্রেম প্রেম ভাব উবে যায় । । তবে ভালবাসা হচ্ছে কারো প্রেমময় সম্পর্কের পরিনতি , যেটা স্থায়ী ।

কিন্তু ছোট যারা আছে তারা আমার কথা শুনে হাসাহাসি করে আর টিপ্পনী কাটে একে অপরকে । আমি বলতাম , তোদের অভিজ্ঞতা কমতো ! তোরা হচ্ছিস বাচ্চা পোলাপান , এইসব বিষয়ে তোরা বুঝবিনা । তাদের দেখানোর জন্য কোন এক বড় ভাইকে আমার কথার প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য যদি বলতাম ভাই, কথা সত্যি কিনা ? তখন তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেন আমিও এককালে ভালবাসতাম একজনরে ।

তিনি শুরু করতেন তার কথা আর আমরা তার পিছন দিয়ে একে একে বের হয়ে যেতাম । ভালবাসায় গদগদ হয়ে ভাইয়েরা হয়েছে আটখানা আর এই ছোট ভাইরা প্রেমে পড়ে ভালবাসা আদায় করার চেষ্টা চালাচ্ছে বারোয়ানা । আমার কোন প্রেমই বেশিদিন টিকেনি বিচিত্র সব কারনে । তবে বিদায়ের বেলায় কেউ কখনও গোমরা মুখে ফিরিনি । হাসিমুখে দা ইন্ড হয়েছে সব।

নিজে হাসতে আর মানুষকে হাসাতে ভালবাসি বলেই সম্ভব হয়েছে । তবে সবচেয়ে বেশি মজা লাগে আর হাসি পায় জেরিনের সাথে সম্পর্কে ইতির কথা মনে পড়লে । বেচারা তার বাবার সাথে দেখা করাতে নিয়ে গিয়েছিল । আমিও গিয়েছিলাম ভাল ভালয় তবে ......

-নাম কি তোমার ?
- বাবা মা একটা রাখছেন , আমি একটা রাখছি , আপনার মেয়ে ডাকে আরেক নামে তার নাকি আমার নাম পছন্দ না । কোণটা শুনতে চান ? আপনি চাইলেও একটা নাম রাখতে পারেন ।
- বেয়াদ্দপ কোনহানকার !
- নামটা পছন্দ হয়নাই। অন্য আরেকটা বলেন ।
-কি কইলা ?
- জি কিছুনা । পরের প্রশ্ন ।
-করো কি তুমি ?
-জি সভাপতি ।
-কিসের ?
-‘চিরদিন বেকার রহিবো’ সংস্থার !!
-ফাইজলামি করো?
-ছিঃ ছিঃ, আস্তাগফিরুল্লাহ...!! আপনার এক পা গেছে গিয়া কবরে,আপনার সাথে
ফাইজলামি করা মানায় আমার??
- কি কইলা ?
- আঙ্কেল আমার পরিচিত নাক কান, গলার ডাক্তার আছে ।
-তো আমি কি করুম ?
- আপনেই জানেন ।
-বাবা কী করে?
- আব্বুজি বাসার অর্থ মন্ত্রী, আমার খরচ চালায়।
-তুমি সোজা কইরা কথা বলতে পারো নাহ??
-জি নাহ, আমার মুখের ২ টা দাঁত বাঁকা !! দেখেন—ইইইইই
-অসভ্য কোথাকার !
-অসভ্য কোথাকার তা আমি কেমনে জানবো?? তবে উগান্ডার হইতে পারে !
পড়াশোনা কদ্দুর??
- পড়াশোনা বহুদুর, বহু বছর ধইরা চলছে এখনো শেষ হয় নাই...!! শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিবিএ তে ঝুইলা আছে ।
-বিবিএ?? ধুর, এইটা তোহ এখন রিক্সাআলাও পড়তে পারে !
-আঙ্কেল আপনি কতোটুকু পড়াশোনা করছিলেন?
- ওই জমানার ম্যাট্রিক পাস । বহুত দাম ছিল তখন আমার ।
-আঙ্কেল এই জমানায় তোহ আপনি রিক্সাআলাও হইতে পারবেন নাহ !! বিবিএ টাও তোহ নাই আপনার !! তবে ফুচকা কিংবা আইস্ক্রিমআলা হওয়ার ট্রাই মারতে পারেন...!!
-ফাউল !
-আঙ্কেল আমি ফুটবল নাহ ক্রিকেট পছন্দ করি...!! ক্রিস জেইল আর হেডাম জিলকৃষ্ট এর ব্যাটিং এ তো পুরা মাথাই নষ্ট হইয়া যায় আমার !!
-কার কার নাম কইলা ?
- ও তাদের আপনি চিনবেন না । তবে ক্রিকেটেও কিন্তু ফাউল আছে একটা ।
-কি ফাউল পাইলা আবার ক্রিকেটের??
-ভিরাট কোহলি !! তারে দেখলেই বুঝা যায় শয়তানে তারে হুদাই নারেচারে , একলা একলাই গালাগালি করে, তার কান্ধে শয়তান যে কয়টা আছে তা এক বিরাট গবেষনার বিষয় !!
-অ ! এই জমানার পোলা প্রেম টেম, ফষ্টি-নষ্টি করোনা??
- প্রেম তো আপনার মেয়ের সাথেই করি এইটা কেমন প্রশ্ন জিগ্যেস করলেন ? তবে নষ্টি-ফষ্টি করার ধান্দা নাই আমার !
-অসম্ভব !! তুমি মাংস খাবা আর ঝোল খাবা নাহ তা কেমনে হয়??
-অসম্ভব কে সম্ভব করাই জলিল এর কাজ...!
-জলিল কে ??
-ব্রেড পিট এর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী !!!!
-ব্রেড পিট কে??
--হলিউড এর ইমরান হাসমি, কথায় কথায় নায়িকাদের জড়ায় ধরে !!
-তার মানে জলিল ও তাই করে ?? ছি ছি, কেয়ামত এর আর বেশি বাকি নাই, দেশ শেষ !!
-জি। যেই গরম পরছে মনে হয় কেয়ামত আসন্ন !! হুদাই আমি এতদিন গরম বাড়ার ভুল ব্যাখ্যা দিতাম !!
-কি ব্যাখ্যা??
- থাক আপনারে না বলি। ব্যাখ্যা শুনলে আপনার সহ্য হবে না । প্রেসার বাইরা যাবে ।
-ছি ছি, তুমি যাও মিয়া সামনে থেইকা...!!
--জি ধন্যবাদ !!

লোকটার প্রেসার বেড়েছিল কিনা জানা নেই , তবে জেরিনের সাথে আর দেখা হয়নি । ফোন দিয়েছিলাম । বলেছিল , ‘আমার সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করবা না ’। জবাবে কোনও ভুমিকা ছাড়াই বলেছিলাম “ উক্কে ’’ ।

শুধুমাত্র জেরিনের সাথেই আমার সম্পর্কের ইতি এভাবে ঘটেছিল । তবে একটা সময় আফসোস ছিল আমার । প্রেমে পড়েছি , সম্পর্কে জড়িয়েছি ঠিকই, তবে কাউকে ভালবাসতে পারিনি মনের মত । আমার সাহিত্যিক বন্ধু ফাইয়াজ আমার এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে বার বার বলত আমি হতবাক, আমি নির্বাক ! জবাবে বলতাম , চুপ থাক বুরবাক ।

ছেলেটা ভাল লিখালিখি করে। বেশ কয়েকটা কবিতার বই বের হয়েছে তার । আমি সময় পেলে মাঝে মধ্যে পড়তাম তার লিখা । কিন্তু কখনও তাকে বলতাম না । আমার সামনে কবিতা বলা শুরু করলে উল্টো আরও বকে দিতাম । ফাইয়াজ আমাকে নিয়েও লিখেছিল কিছু লাইন ।

যখন জীবনটা মনে হবে এক আলো ছায়ার খেলা
তখন কেটে যাবে জীবন থেকে অনেকটা বেলা
রয়ে যাবে তুমি এক ল্যাম্পপোস্টের মত স্থির
না আসবে আলো না আসবে আধার
বিষাদময় শুন্য মনে ছড়াবেনা আবির।

লিখাটা ভাল লেগেছিল তবে দুষ্টামি করেই আবার ঝারি মেরে বলেছিলাম , ‘আরেকটা বার যদি আমার সামনে তোর কবিতা কইছস তো তোর হাড্ডি ভাইঙ্গা গুড্ডি উড়াবো ।’

ফাইয়াজ ঠিকই বলেছিল হয়ত । ল্যাম্পপোস্টের মতই স্থির হয়ে আছি এই হাসপাতালের বেডে তবে আলোহীন । কোথাও আড্ডা দেয়া নেই , ঘুরতে যাওয়া নেই । শুধু রুমে আর উঠোনটায় হালকা হাটাহাটি করা আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরব কবে সেটার দিন গননা করা । মনে কোন আবির ছড়ায় না আর । মাঝে মধ্যে বন্ধুরা আসে, কিছুক্ষণ থেকে চলে যায়।

হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী রোগীর সাথে বাইরের মানুষদের বেশীক্ষণ থাকতে নেই । বড়ই অসামাজিক আচরন লাগে ডাক্তার এবং নার্সদের যখন তাদের চলে যেতে বলে । দরজার পর্দার ফাকে রুমের বাইরে ডাক্তারের সাথে বাবাকে কথা বলতে দেখলাম । শুধু বলতে শুনলাম অপারেশনের পর দুটা বিষয় হতে পারে । হয় পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে নয়ত আর জ্ঞান ফিরবেনা । মারা যেতে পারে। আল্লাহকে স্মরণ করুন । ডাক্তারকে চলে যেতে দেখলাম । মিষ্টির বাবা আর মিষ্টিকেও দেখলাম বাবার সাথে । মিষ্টি অঝোরে কাঁদছে ।

মিষ্টির সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকে । লোকে বলে , এসব সামাজিক নেটওয়ার্কে পরিচিত হওয়া মানুষদের বিশ্বাস করতে নেই । আমি মানতাম না কথাটা এবং আমি মিষ্টিকে বিশ্বাস করে ঠকিনি । কেন যেন অবিশ্বাস করতে পারতাম না মেয়েটাকে । জীবনে কেউ না কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে । পরিচিত হওয়ার জন্য কিংবা একে অপরকে জানার জন্য শুধু দরকার একটা মাধ্যম ।

আমাদের ক্ষেত্রে ফেসবুকটাই মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে । আমি তখনও জানতাম না যে মেয়েটা আমাদের ২ বাড়ির পরের বাড়িতেই থাকে। কিন্তু সে জানত । আমার ছবি দেয়া ছিল আর তার ছিল না । তার ছবি দেখার পরই তার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। মেয়েটা হাসি মুখে বারান্দায় দাড়িয়ে ছিল আমায় দেখে । সত্যি বলতে মেয়েটাকে আমি ভালবেসেছিলাম এবং সত্যিকার অর্থেই ভালবেসেছিলাম।

বেশ আগে থেকেই হালকা মাথা ব্যথা করত সে হিসেবে বলা যায় অসুস্থ বোধ করাটা অনেকদিনের পুরনো । বলতাম না কাউকে । মাঝে মাঝে যন্ত্রণাটা অসহ্য মনে হত । এমনও হয়েছে চিৎকার চেচামেচি করেছি যন্ত্রনায়। যতক্ষণ পারতাম ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতাম । বাবা অফিসে যাবার সময় দেখতেন ঘুমাচ্ছি , ফেরার পরেও দেখতেন ঘুমাচ্ছি । মাঝ রাতে জেগে উঠতাম ।

তখন মিষ্টিকে ফোন দিতাম কিন্তু কথা বলতাম না , শুধু তার আওয়াজটা শুনতাম । ভাল লাগত এমন পাগলামি করতে । মেজাজটা খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল । দিনকে দিন আমার উচ্ছলতা কমে যাওয়ায় বাবা চিন্তিত হয়ে পড়েন । পাশের ফ্ল্যাটের আন্টিকে বলে যেতেন যাতে মাঝে মধ্যে আমাকে দেখে যান। তিনি আসতেন ঠিকই আর আমিও তাকে কিছু হয়নি বলে ফিরিয়ে দিতাম । মাঝে মধ্যে খাবার রেঁধে পাঠাতেন । পরেই থাকত সেগুলো ।

মানুষের উপস্থিতি অসহ্য লাগা শুরু হয়েছিল । ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বাবা । আমি যেতে চাইতাম না । মিষ্টির সাথে যোগাযোগ কমে গিয়েছিল । মাঝে মধ্যে ফোন ধরতাম । সে বারবার আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে জিগ্যেস করত । এটা করোনা কেন ওটা কেন করোনা বলেই যেত । আমি কিছু বলতাম না , চুপ করে শুনে যেতাম । কথার উত্তর দিচ্ছিনা কেন জিগ্যেস করলে বলতাম কিছু হয়নি , ঠিক হয়ে যাবে , চিন্তার কিছু নেই ।

সেদিন সন্ধ্যায় যন্ত্রণাটা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। মাথা ধরে চিৎকার করতে থাকি। চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল । কোনরকম মাথায় পানি ঢালি কতক্ষণ । যন্ত্রণা একটু কমলেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না । কোন মেডিসিনও খুঁজে পাচ্ছিলাম না ঘরে । বের হয়ে গেলাম বাসা থেকে । দিক্বিদিক হারিয়ে বেসামাল ভাবে ছুটছি । কতক্ষণ ছুটেছি খেয়াল নেই । রাস্তায় পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারানোর আগে ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখেছিলাম দূর হতে মিষ্টি দৌড়ে আমার দিকে ছুটে আসছে ।

অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবার আগে বাবাকে দেখতে চাইলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলেন কতক্ষণ। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন কিছু হবে না । সব ঠিক হয়ে যাবে। মিষ্টিকে দেখলাম দূরে দাড়িয়ে কাঁদছে । কিছু বললাম না তবে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে । থিয়েটারে নিয়ে যাবার পর ডাক্তারকে একবার জিগ্যেস করলাম , ডাক্তার, আমি শুধু জানতে চাই আমার সমস্যাটা কি ?

ডাক্তার বললেন , ছোটোখাটো একটা টিউমার যার কারনে মস্তিস্কে রক্ত চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। স্বাভাবিক অক্সিজেন পাচ্ছেনা যার কারনে মাথা যন্ত্রণা করে । অপারেশনের পর সব ঠিক হয়ে যাবে । চিন্তার কিছু নেই । সিরিঞ্জে করে তরল পদার্থ প্রবেশ করানো হল দেহে । তলিয়ে গেলাম ফের অন্ধকার দুনিয়ায়।

ক’ ঘণ্টা কেটে গেছে জানিনা । জ্ঞান আসার পরও তাকাতে পারছি না । ঘোলাটে আর বিদঘুটে লাগছে সব । মাথাটা পাথরের মত ভার হয়ে আছে । ব্যান্ডেজ লাগানো , নাড়াতে পারছি না । যন্ত্রণাটা কমেনি বরং বাড়ছেই । আসেপাশে মনে হচ্ছে অনেকের অস্তিত্ব । আমার হালকা নড়াচড়া দেখে হয়ত তারা আমায় ডাকছে , চিৎকার করে ডাকছে ।

কেউ আমার জ্ঞান ফেরার আনন্দে ডাকছে , কেউ হয়ত আমি উত্তর দিচ্ছি না কেন এই দুশ্চিন্তায় । কিছুই দেখতে পারছিনা । শোনার শক্তিও কমে যাচ্ছে । জ্ঞানটা হয়ত ফিরেছে শেষ বারের মত কাছের মানুষগুলোর কথার আওয়াজ গুলো শোনার জন্য । মনে হল ক্রমেই অনুভুতি হারাচ্ছি । শক্তি হারিয়ে ফেলছি । চোখের আলো কমে যাচ্ছে । চোখের সামনে ঘোলাটে ভাবটা সরে যাচ্ছে ।

এক ছায়া গ্রাস করে ফেলছে । আধারে নেমে যাচ্ছি আমি। আলো ছায়ার খেলায় হেরে যাচ্ছি , হারিয়ে যাচ্ছি জীবন থেকে । ছায়ার মাঝে দূর থেকে একটা আলো চোখে লাগছে । কে ওখানে ? মা ? মা দাড়িয়ে আছেন ! আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি মা দাড়িয়ে আছেন । আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন । এগিয়ে যাচ্ছি মায়ের দিকে । মা হাতছানি দিয়ে ডাকছেন আমায় , আমার মা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন !

লেখক: মোঃ মঈন উদ্দিন সাব্বির

এটাও তো ভালোবাসা

অনেকদিন হল তোমার কোন খোঁজ নেওয়া হয়না। দেখতেও আসতে পারি না। আসলে কাজের চাপটা এতটা বেড়েছে যে সব সামলাতে রীতিমত বেশ হিমশিম খাচ্ছি। এখন বুঝি কেন তুমি খুব করে চাইতে আমি সরকারী চাকরী করি।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আসলেই এত অত্যাচার করে। আর আমার মত নতুন জয়েন করা ছেলেগুলোকে রীতিমত কিমা বানিয়ে ছাড়ে। তুমি কিন্তু এ নিয়ে একদম চিন্তা করবেনা। আমি মানিয়ে নিয়েছি, এখন বেশ ভালোই আছি। কথা দিচ্ছি এবার সুযোগ পেলেই তোমায় দেখতে ছুটে আসব। তোমার থাকার জায়গাটার পাশে যেই গোলাপ ডালিয়ার গাছ আছে সেখানে বসে খুব গল্প করব।

যখন অনেক কাছে ছিলে তখন কথাই হতো না তোমার সাথে। আর এখন যাই ঘটেনা কেন মনে হয় আগে তোমায় গিয়ে বলি। কিন্তু সে সুযোগ এখন আর নেই। আমার কি দোষ বল? আমি খুব করে বলতাম এখানেই কোন এক জায়গায় তোমার থাকার জায়গাটা হবে।

কিন্তু তুমি তোমার মায়ের সাথেই থাকবে। আচ্ছা দাদুমনির সাথে কি খুব কথা হয় এখন? কেমন আছে উনি এখন? উনার উপর ভীষণ রাগ আমার।আমাদের একা করে নিজের ছেলেকে এভাবে নিয়ে গেলো। মায়ের সাথে থাকতে গিয়ে আমাদের কথা মনে পড়ে তোমার?

তুমি মানুষটা এত আগে চলে যাবে ভাবিনি কখনো। কি এত অভিমান ছিল তোমার জানিনা।তোমার চলে যাবার কিছুদিন আগের কথা। আমি তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ার এ পড়ি। হঠাৎ কেন জানি খুব দামি একটা ব্র্যান্ডের শার্ট পড়তে ইচ্ছে হল আমার। আমাদের বেশ টানাটানি চলছিল তখন।তাই তোমাকে আর বলিনি তখন।কিন্তু ঠিকই ঈদে তুমি আমাকে সেরকম একটা শার্ট কিনে দিলে।

মাকে বলেছিলে,"এখন তো বাবা কিনে দিচ্ছে। ছেলেকে ভালমত পড়ালেখা করতে বল যাতে নিজেও এমন জামা কিনতে পারে। "আচ্ছা বাবা তুমি কি বুক ভরা অভিমান নিয়ে একথা বলেছিলে? আমি তো তখনও চাকরী করার মত যোগ্য হয়ে উঠিনি। তবে তোমার কথা রেখেছি আমি। অনায়াসে কয়েকটা দামি শার্ট মাস শেষেই কিনতে পারি। তোমার জন্যও কেনা হয়। কিন্তু একসাথে পরার সুযোগ হয় না।অবশ্য তোমার দেয়া সেই জামাটাও আমি পরিনি। রেখে দিয়েছি। যেদিন আমাদের দেখা হবে আবার সেদিন পরবো।আমার দেয়া জামা পরে তুমি খুশি হবেনা বাবা?

আলতাফ সাহেবের কথা মনে আছে তোমার? ঐ যে তোমার অপারেশনের সময় যে টাকা চেয়েছিলাম। লোকটা নাকি সম্পর্কে আমাদের আত্মীয় হয়।যদিও তার আচরণে সেকথা মনে হয়নি কখনো আমার। তার টাকাগুলো শোধ করে দিয়েছি। বিদেশি ব্যাংকের চেকটা দেখে ভদ্রলোক ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি এটা আমি দিচ্ছি।

আসলে সেতো তোমাকে মধ্যবিত্ত,ছাপোষা মানুষ হিসেবে দেখেছে কিন্তু বাবা হিসেবে তুমি কেমন হতে পারো ভাবেনি। তুমি শুধু বাবাই ছিলে না,ছায়াও ছিলে আমাদের। ঈশ্বর যখন বুঝল তোমার দায়িত্ব অনেকটাই পালন শেষ তখনই তোমায় নিয়ে গেলো। কিন্তু বাবার দায়িত্ব কি কখনো শেষ হয় বল? বিশ্বাস করো বাবা,তোমার চলে যাওয়ার পরের দিনগুলো কি যে কষ্টে কেটেছে আমাদের। অভাব অনটনে মা ছেলে কিভাবে বেঁচে ছিলাম বুঝাতে পারব না।

ভালো খাবার,দামি কাপড়ের কথা ভাবতেই পারতাম না। একরুমের একটা ছোট্ট বাসা নিয়েছিলাম। প্রায় সব আসবাবপত্র বিক্রি করে দিয়েছিলাম। বাড়িভাড়া,কলেজের বেতন সব কিছুর জন্য শেষদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত। আচ্ছা বাবা তুমিতো স্বর্গে আছো না? সৃষ্টিকর্তাকে একটাবার জিজ্ঞেস করো আমাদের এভাবে কষ্ট দেয়াটা খুব কি জরুরী ছিল?খুব কি পাপ ছিল আমাদের?

আচ্ছা বাবা নিতুকে তো চিনতে তুমি তাইনা?ঐ যে সেই মেয়েটা।যাকে নিয়ে মা সারাদিন আমাকে বকা দিত।কিন্তু তুমি সব জেনেও আমাকে সাপোর্ট দিতে।মেয়েটাকে বেশ পছন্দ ও করেছিলে তুমি।ওর সাথে এখন আর আমার যোগাযোগ নেই।কি করে থাকবে বল?তুমি বাবা হয়েই চলে গেলে আর ও তো অন্য মানুষ।জানো বাবা ওর পরিবার নাকি পিতৃহীন একটা ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ছিল।

শঙ্কাটা ওর নিজেরও ছিল।ওর সাথে ঘণ্টাখানেক কথা বলার টাকাও ছিলনা আমার তখন।এখন অফিস থেকেই আমার ফোনের টাকা দেয়।মেয়েটা কি বোকা তাইনা?তবে ওকে আর কি দোষ দিব বল।কত মানুষ কত কি বলত।সবচাইতে খারাপ লাগে কখন জানো?যখন মানুষ এতিম নামক এক অদ্ভুত জঘন্য শব্দ ব্যবহার করে আমার পরিচয় দিত।

আচ্ছা বাবা কে বলেছে তুমি নেই?আমার ঘরের জানালা দিয়ে তাকালে পুব দিকটায় যে তারাটা দেখি,কথা বলি সেটাতো তুমিই তাইনা বাবা?আমি আগে বৃষ্টি দেখতাম আগ্রহ নিয়ে।এখন মেঘলা আকাশ আমার ভালো লাগেনা।মেঘগুলো যে আকাশে তারা হয়ে থাকা বাবাটাকে ঢেকে দেয়।আমাকে তুমি হয়তো অনেক খারাপ ভাবো,অনুভূতিহীন একটা মানুষ ভাব।কিন্তু তোমার অসুস্থতার সময় কত রাত আমি কেঁদেছি তা শুধু আমিই জানি বাবা।

মাকে তুমি খুব ভালবাসতে কি?মা কিন্তু তোমাকে বেশ ভালোবাসতো।তুমি চলে যাবার পর আমি দেখেছি মানুষটার কান্না,মনের অবস্থা।আসলে মধ্যবিত্ত জীবনটা ভালোবাসার অনুভূতিকেও মেরে ফেলে।সংকোচে ফেলে দেয় তা প্রকাশে।

মা কি পৌঁছে গেছে তোমার কাছে?হ্যাঁ বাবা।গত পরশু মাকেও তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।তোমাকে ছাড়া সে যে আর থাকতে পারছেনা।এজন্য আমার খুব একটা মন খারাপ নয়।দেখছনা কি সুন্দর তোমাকে লিখে যাচ্ছি।আমি জানি তুমি মাকে ভালো রাখবে।বেশ ভালো রাখবে।

বাবা একা হয়ে আমি খুব ক্লান্ত।তোমার আর মায়ের কাছে আমারও আসতে ইচ্ছে করছে।আমাদের পরিবারটা আবার একসাথে থাকবে।আবার তোমাকে জ্বালাব,মার বকা খাব।বাবা,সকালে ক্লাস মিস হলেও তুমি আমাকে জাগাতে না।বলতে ছেলেটা আরেকটু ঘুমাক।আমি ঘুমাতে চাই বাবা।যে ঘুমের পথ ধরে তোমার আর মায়ের সাথে থাকতে পারব।কখনো বলিনি।কিন্তু সত্যিই তোমায় ভালোবাসি বাবা,তোমাদের ভালোবাসি...

লেখক: রুবায়েত তন্ময়

আই লাভ ইউ বাবা

অনেক রাত হয়ে গেলো ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুম আসছেনা চোখে পায়ে খুব ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে সবাইকে বলেছি সামান্য কেঁটে গেছে ডাক্তার জোর করেই ব্যান্ডেজ করে দিল। আসলে সেদিন হঠাৎ আকস্মিক এক্সিডেন্ট এবং পায়ে অনেক বেশী আঘাত মাংস ছিঁড়ে হাড্ডি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।

বরাবরই আমি চাপা স্বভাবের এমনিতে আমাকে নিয়ে আমার ফিউচার নিয়ে সবার মাঝে অনেক টেনশন তার উপর এসব দুর্ঘটনার কথা শুনে আমার জন্য কেউ কষ্ট করলে নিজের খুব অপরাধ বোধ হবে। তাই ড্রেনে পড়ার কথা বলে বাইক এক্সিডেন্ট এর কথা চাপিয়ে গেলাম। রাত যতই বাড়ছে ততই ব্যাথা বেড়েই চলেছে না আর পারছিনা চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

এমন সময় রুমে বাবার আগমন যদিও আমার রুমে তিনি তেমন আসেন না আর উনার সাথে আমার তেমন কথাও হয়না কারন উনার চোখে আমি অকর্মা আর নিজের অপছন্দের দলের রাজনীতির সাথে জড়িত তাই আমাকে সহ্য করাটা অসম্ভব। রুমে প্রবেশ করার সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ঘুমের অভিনয় করি এত রাতে পায়ে তীব্র ব্যাথা নিয়ে উনার নীতিবাক্য শুনার ইচ্ছেও আমার নেই।

উনি এসে বিছানায় বসলেন পা থেকে কাপড় সরিয়ে ব্যান্ডেজ বাধা পা দেখতে লাগলেন কিছুটা রক্ত দেখে তার দুচোখে অশ্রুর বন্যা শুরু হলো টপটপ করে ঝরে পড়ছে আমার দেহে এ অশ্রুবিন্দু আমার সমস্ত যন্ত্রনা ভুলিয়ে দিচ্ছি এতদিনের সকল অভিযোগ অভিমান ঘুছিয়ে দিচ্ছি অদৃশ্য এক শক্তিতে। আমারও ইচ্ছে হচ্ছে ছোট বেলার মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে বাবার বুকে মাথা গুঁজে কিন্তু বাবার এই অকৃত্রিম ভালবাসা আমি হারাতে চাইনা।

কতদিন ব্যাকুল হৃদয় অপেক্ষা করেছে বাবার স্নেহের স্পর্শের জন্য তা আজ বুঝতে পারছি। পায়ে এখনো ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে কিন্তু এই ব্যাথাটা অনেক প্রিয় মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে এক্সিডেন্ট না হলে বুঝায় হতোনা বাবাকে বাবার এত্ত আন্তরিক ভালবাসাকে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল আমি কিন্তু ঘুমের অভিনয়ে ব্যস্ত আমার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম বাবার নজর এড়ায় না পাশে পড়ে থাকা হাতপাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগলো আমার। না আর অশ্রু থামাতে পারছিনা তাই কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম।

রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো ফজরের আজান দিচ্ছে। ইস রাতটা যদি শেষ না হতো আর একটু বড় হলে কি ক্ষতি হতো ভালবাসাময় এই রাতটা। ফরজের নামাজ পড়তে বাবা রুমে চলে গেল আমার পাশেই বাবা মার রুম তাই আমিও দেয়ালের পাশে দাঁড়ালাম মাকে ঘুম থেকে ডাকলেন বাবা।

এতক্ষণ কোথায় ছিলে ঘুমাওনি কেন? ছেলেটাকে খুব অবহেলা করো তোমরা আমিতো বাবা তাই ওর পাশে ছিলাম তুমি জানো তোমার ছেলে এক্সিডেন্ট করেছে? আরে না ওতো ড্রেনে পড়েছে। মিথ্যে বলেছে শোন ওকে নিয়ে কাল ভালো ডাক্তারের কাছে যাবে আমি টাকা দিয়েছি বলোনা তাহলে যাবে না ওর দিকে নজর রেখ অনেক অগোছালো ছেলেটা আমি আর কদিন জানিনা আমি চলে গেলে কি করবে ছেলেটা।

বাবার কন্ঠ অনেক ভারী মনে হচ্ছে হয়ত তিনি কাঁদছেন হ্যাঁ কাঁদছেন শাসনের আড়ালে এতদিনের ভালবাসা গুলো অশ্রু হয়ে বেড়িয়ে আসছে। বুকের মাঝে হুহু করে উঠল আসলেই তো কি হবে বাবা না থাকলে না আর ভাবতে পারছিনা আজ নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে এতদিনের সব জানা শুনা ভুল ছিল, ভুল ছিল বাবাকে বুঝার মাঝে তাই ইচ্ছেমত কাঁদলাম। সকালে খুব বকাঝকা করলেন পুর্বের মত অকর্মা, গাধা ইত্যাদি অপমানসুচক শব্দ ব্যবহার করলেন।

কিন্তু আজ আমার মন খারাপ হচ্ছেনা মনে মনে আক্ষেপ হচ্ছেনা বরং খুব হাসি পাচ্ছে একজন দক্ষ অভিনেতার অভিনয় দেখে। আমার হাসি দেখে বাবারও হাসি পাচ্ছে জানি কিন্তু গাম্ভীর্য দিয়ে তা ঢেকে রাখছেন। সারাজীবন আমাদের বাবারা অভিনয় করে যান শাসনের অভিনয় গাম্ভীর্যের অভিনয়। কিন্তু আমাদের উজ্জল ভবিষ্যৎ এর জন্য তাদের এই অভিনয় টুকু করতেই ভালবাসা বুকে চাপা রেখে। আমাদের মা বাবারা সারাজীবন আমাদের তুষ্ট রাখার জন্য আমাদের মাথা উঁচু করার জন্য নিচের মাথা অনেক নিচুতে নামতেও দ্বিধাবোধ করেন না।

তাদের আশা বেশী কিছু নয় জীবনের পড়ন্ত লগ্নে সবার সাথে হেসে খেলে জীবনের ইতি টানা। কিন্তু মাঝেমাঝে হিসেব গুলিয়ে যায় তাদের হাতে গড়া প্রিয় নীড় ছেড়ে দুরে সরে যেতে হয় যতনে মানুষ করা সন্তানেরা একদিন তাদের প্রিয় নীড় ছাড়তে বাধ্য করে এবং তাদের ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমের চার দেয়ালের বন্দী কুটিরে। ইদানীং একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম সামান্য ভুলের কারনে বন্ধু কাছের অনেক মানুষ দুরে চলে যায় মুহুর্তে সেখানে হাজার ভুলের মাঝেও বুকে জড়িয়ে রাখতে পারেন শুধুমাত্র মা বাবা বলেই তাদের ভালবাসার কাছে সব তুচ্ছ নগণ্য।

লেখক: হাসান রুদ্রনীল।

সেই সব যুবকদের বলছি


আজ প্রেমের নামে মেয়েদের সরলতার সুযোগে সতীত্ব হরন করে উচ্ছাসিত মনে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিচ্ছ অবলীলায় যেসব যুবক আবার তা নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে অহংকার করে বলো আমি এতজন মেয়ের সাথে প্রেম করে তাদের সতীত্ব নষ্ট করেছি। সে সব যুবকদের বলছি তোমরা কখনো সুখী হয়োনা এই ভেবে যে তুমি মেয়েটিকে অপবিত্র করেছ বরং আফসোস করো

এই ভেবে যে তুমি নিজেই নষ্ট হয়ে গেছ তোমার চরিত্র নিম্নমানের তথা বনের পশুর মত হয়ে গেছে এবং এমন কাউকে তুমি হারিয়েছ যে তোমাকে সবচেয়ে বেশী বিশ্বাস করে তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ সঁপে দিয়েছে যে বিশ্বাসের যোগ্য তুমি নও। আবার যেসব নারী ক্ষণিকের মোহে ভয়ানক মিথ্যে প্রেমের ফাঁদে ফেলে নির্লজ্জভাবে আজ যে প্রেম পুজারী ছেলেকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিয়ে হাসিমুখে অন্য কোন পুরুষের সাথে বুনো উল্লাস করো।

সেসব প্লে-গার্ল পরিচয়ে গর্ববোধকারী ললনা যাদের কাছে প্রেম মানে টাইম পাস আর দামী ফাস্টফুড খাওয়া তাদের উদ্দেশ্য বলছি ভেবোনা তুমি জয়ী হয়েছ নিষ্ঠুর এ খেলায় বরং কাঁদো এই ভেবে যে এমন কেউ তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে যে তোমার হাসির জন্য মরতে পারে আজ যা তোমার কাছে খেলা একদিন তা তোমার কিংবা অন্যর ধ্বংসের এবং মৃত্যুর কারন হতে পারে।

ভালবাসা এবং বিশ্বাস অনেক পবিত্র গুরুত্বপূর্ণ একবার নষ্ট হলে আর সৃষ্টি হয়না।এই অকৃত্রিম প্রেমের বিশ্বাস নষ্টের কারনেই আজ পশ্চিমা দেশ গুলোতে ভালবাসা বিলীন করে শুধুমাত্র সেক্স নির্ভর হয়ে পড়েছে মানুষ যার ফলশ্রুতিতে সংসারের মত গভীর ভালবাসাময় বন্ধন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা।কিন্তু আমাদের দেশের সংস্কৃতি ঐতিহ্য অনুযায়ী সুদুর প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মধ্যে ভালবাসার অকৃত্রিম বন্ধন গড়ে ওঠেছে সাংসারিক জীবনের মাধ্যমে সেখানে শুধুমাত্র সেক্স মুখ্য বিষয় নয় বরং জড়িয়ে রয়েছে নিবিড়ভাবে বিশ্বাস ভালবাসার সুনিপুণ স্তম্ভ যা কিছু মানুষের কারনে বিলীন হতে পারেনা কোনভাবে।

তাই প্রেমের নামে ছলনা করোনা কারো সাথে কারন তোমার যা শুধুমাত্র দুদিনের খেলাঘর অন্যর কাছে তা স্বপ্নের প্রাসাদ। ভালবাসা স্রষ্টা প্রদত্ত স্বর্গীয় দান যা হতাশাগ্রস্থ মানুষকে অন্ধকার জীবন থেকে আলোর পথে নিয়ে আসে।আবার প্রতারনার কারনে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করায়।তাই আসুন ক্ষণিকের মোহ ও বিকৃত যৌনচার ত্যাগ করে পবিত্র অকৃত্রিম ভালবাসায় জগতকে আলোকিত করি।পবিত্র প্রেম এবং প্রেম পুজারী আছে বলেই তো পৃথিবী এত সুন্দর ও বসাবাস যোগ্য।

লেখক: হাসান রুদ্রনীল

এক অসহায় বাবা বলছি


ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি বাবা-মেয়ে। একটা সময় বুকটা ধক করে উঠলো। পিচ্ছিটার ডাকে আমার লেগে লেগে আসা ঘুমটাও ভেঙ্গেগেছে। চোখ কুচকে জিগেস করি,"কি হয়েছে মামুনি?"

"বাবা,মায়ের শাড়িটা উঠোনে ভিজে যাচ্ছে, নিয়ে আসি?"- আমার মেয়ে বলে উঠে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি,"না থাক,ওটা ওখানেই থাকুক"। পিচ্ছিটা বলে,"বাবা,মায়ের তো আর শাড়ি নেই। কাজ থেকে এসে কি পরবে?"

ক্রাচে ভর দিয়ে বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করি। আমার মেয়ে ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে আমার বাহু আকড়ে ধরে। "বাবা,তুমি উঠোনা,আমি নিয়ে আসছি "-আমাকে কাতুর কন্ঠে বলে।

-তুমি নাগাল পাবে না তো মা।

-আমাদের বাইরে একটা ভাঙা চেয়ার আছে বাবা,ওটাতে উঠে দড়ির উপর থেকে মায়ের শাড়ি নিয়েয় আসবো।

আমি চুপ থেকে সম্মতি জানাই। এই মুহুর্তে আমার আদরের মেয়েটিকে,আহ্লাদের মেয়েটিকে আমি বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।যদি চেয়ার থেকে ও পিছলে পড়ে যায়! ভাবাচ্ছে আমাকে। কিন্তু আমার কিছু করার নেই।

মেয়েটা আস্তে আস্তে এগুতে থাকে। উঠোনে বৃষ্টির ফোটা পড়ছে। মাটিগুলো সরে যাচ্ছে। আমার মেয়ে ধীরে ধীরে চেয়ার টা নেয়। প্লাস্টিকের চেয়ার। চেয়ারের দুটি হাতল ধরে উঠার চেষ্টা করে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বুকটা কেমন যেন ধক করে উঠে। যদি ও পড়ে যায়?

একটা সময় প্রচন্ড বাতাস আসে। পিচ্ছি মেয়েটার মাথার চুলগুলো উড়তে থাকে। এবার মেয়েটা চেয়ার এর উপর উঠতে পারে। আমার বুকের ভেতর প্রচন্ড একটা ব্যাথা হচ্ছে। আমার হৃদপিন্ডের অর্ধেকটা জুড়েই যে আমার মেয়ে!

বৃষ্টির ফোটায় উঠোনের মাটি সরে যায়।ক্রমশ বাতাস বইতে থাকে। একটা সময় দুঃস্বপ্নের মতো আমার মেয়েটা চেয়ার থেকে পড়ে যায়। হাটুতে চেপে ধরে কান্না করে। "বাবা" বলে চিৎকার করে। আমার চোখের সামনেই। আমার পরীর মতো মেয়েটার গায়ে কাদা লেগে যায়।ব্যাথায় কাতরাচ্ছে সে।ক্রাচটা খাট থেকে মোটামুটি দুরে। আমি আজ এমনই এক হতভাগা বাবা যে নিজের মেয়েটাকে পর্যন্ত আগলে রাখতে পারলাম না। এমনই হতভাগা বাবা যে আমার চোখের সামনে আমার মেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কাদছে। গায়ে কাদা মাটি মাখছে। দু হাত তুলে আল্লাহর কাছে বলি,"আল্লাহ,আমাকে দুটা মিনিটের জন্য শক্তি দাও,দয়া কর আল্লাহ! "

সৃষ্টিকর্তাটাও তখন বড় নিষ্ঠুর হয়ে যায়। ইচ্ছে করেই বৃষ্টির শব্দ বাড়িয়ে দেয় যেন আমার চিৎকার যমীন থেকে আসমানে না পৌছায়। যেন আমার মেয়ের চোখের পানি আর বৃষ্টির পানি আলাদা করে না দেখা যায়!

আমি কাদতে থাকি। আমি উঠতে পারিনা। এ দেহে প্রাণ আছে কিন্তু প্রাণের সঞ্চার নেই। আমার অবুঝ মেয়েটা বুঝে যায়,তার বাবা তাকে বাচানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। হামাগুড়ি দিয়ে আমার কাছে আসে। গায়ে কাদা নিয়েই আমার বুকে এসে পড়ে। সেই কাদা নিয়েই আমার ক্লান্ত মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ে। ব্যাথায় কাতুর মেয়েটা একটি বারের জন্য ও বলেনি সে ব্যাথা পাচ্ছে খুব। শুধু জানতে চাচ্ছিলো, তার মা কখন আসবে। হয়তোবা মেয়েটি জানে,তার বাবা আজ কিছু করতে পারবে না তার জন্য। আজ না শুধু,চিরজীবনের জন্য!

এক বছর ধরে শরীরের বাম পাশ প্যারালাইজড। না পারি হাটতে,না পারি চলতে। মাঝে মাঝে নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে বড় অমানুষ মনে হয়। আমি না একজন আদর্শ স্বামী,না একজন আদর্শ বাবা!

গত বছর থেকে আমি অসুস্থ্য। সংসারের চাকাটা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। যেদিন শেষ আধা কেজি চাল ভাতের পাতিলে ঠাই পায় সেদিন আমার বউ এর মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। পাতিল থেকে মাড় ঝরানোর সময় আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো উদাস নয়নে। ঠিক তখনই আমার বউ এর মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে চাকুরী পায় সে। অভাবের মুখটা না দেখতে হলেও উচ্চমধ্যবিত্তের সুখটা আর পাওয়া হয়নি।

সেদিন থেকে শুরু হয় এক পরিশ্রমি,এক সংগ্রামী নারীর গল্প। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাচটা পর্যন্ত স্কুল করিয়েও যখন মাস শেষে অনেক বিশাল খামের ভেতর চার পাচটা পাচশো টাকার নোট সুখ আনতে পারেনা তখন সিদ্ধান্ত নেয় টিউশানির। ভোরে,খুব ভোরে পঙ্গু স্বামী আর ছোট্ট মেয়েটার জন্য রান্না করে মেয়েটি। পাতিল ঘসতে ঘসতে ফর্সা হাতটা যখন কালো হয়ে যায়, সেই কালো হাত ঘসে মেজে ধুয়ে আমাদের বাবা-মেয়েকে উঠিয়ে দেয়। খাইয়ে দাইয়ে প্লেট,পাতিল ধুয়ে দিয়ে সে চলে যায় তার কাজে।

পঙ্গুত্ব বরণ করার পর থেকে আমি এই মেয়েটার মাঝে অস্বাভাবিক মানসিক পরিবর্তন দেখি। রাগী,জেদি মেয়েটা যেন মুহুর্তেই বুঝে গেলো জীবনের বাস্তবতা। প্রতি সপ্তাহে আমার ওষুধ খরচ,আনুসাঙ্গিক খরচ সব এখন তার মাথার উপর। নিজেকে খুব অপরাধী লাগে। সুখে রাখার কথা দিয়ে যাকে আমার করে নিয়েছিলাম, আজ সে আমাকে সুখ দিয়ে যাচ্ছে। সর্বোচ্চ সুখী রাখার চেষ্টা করছে।

মাঝে মাঝে মেয়েটা অবুঝ হয়ে যায়।আমাকে হুট করে বলে উঠে,"আচ্ছা,সত্যিই কি তুমি আর ভালো হতে পারবে না? আমি কি আর পারবোনা তোমার হাত ধরে খালি পায়ে ঘাসের উপর হাটতে?" আমার একটা দীর্ঘশ্বাস তার উত্তর দিয়ে দিয়ে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে একটা হাসি দেয়। চিৎকার করে বলে,"তাতে কি? হয়তো ঘাসের উপর তোমার সাথে হাটলে শামুকে পা পড়তো আমার, রক্ত ঝরতো। তোমার কি সহ্য হতো বলো?" আমি বলি,"একটুও না! "

সে হেসে দেয়। বলে,"দেখেছ আমি কত্ত সুখে আছি! আমি সারাদিন তোমার মাথায় হাত বুলাতে পারি। সারাদিনই তোমার হাত ধরে রাখতে পারি। আমার পা শামুকে কাটে না।" আমি বুঝতে পারি সে সুখ খুজে নেয়ার চেষ্টা করছে।

রাতে আমাদের দুজনকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি জেগে থাকে। পরের দিনের কাজ গুছিয়ে রাখে। অনেক রাতে যখন আমি নাক ডেকে ঘুমানো শুরু করি তখন সে ঘুমোতে যায় মাত্র! কখন উঠে যায় আবার আমি বুঝতে পারিনা।

মাঝে মাঝে ওকে আমি স্যরি বলি। আমি কেদে দিই ওর হাত ধরে। আমি ওকে কিছু দিতে পারিনি। ও তখন আমাদের পুতুলের মতো মেয়েটার চুলে হাত বোলায়। কাপা গলায় বলে,"এই যে দিয়েছো। আমার আরেকটা জীবন! "

ওর সুখের পরিধিটা এখন ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু ও এই পরিধির মাঝেই ভালো থাকার চেষ্টা করে। চেষ্টা করে ওর মাঝেই আরো দুটো জীবনকে সুখে রাখার। কে জানে,সে আসলে কট্টুক সুখ পাচ্ছে...

লেখক : আলেকজেন্ডার আবীর

মহামায়া


দরজার ওপাশ থেকে আড়াল হয়ে রবিনের ঘরের দিকে চুপি দিচ্ছে মায়া। মুখে হাসির রেখা । রবিনকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে । কখনও একটু বেশি ঝুকে পরছে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে চুপি দিচ্ছে । ভেতর থেকে রবিন মুচকি হাসছে মায়াকে দেখে। রবিনও মায়ার মত করে লুকোচুরি খেলছে । ছোট্ট একটা মেয়ে । বয়স আড়াই বছর হবে ! অনেক দুরন্ত ।

একঘর থেকে আরেক ঘরে দৌড়ে বেড়ায় কচি দু পায়ে । বাসার এমন কোন জায়গা নেই যেখানে মায়ার ছোট্ট দুটি পায়ের স্পর্শ পরেনি । সারাটা ঘর মাতিয়ে রাখে । দেখতে এতই মিষ্টি , যে কেউ দেখলেই তাকে কোলে নিয়ে গাল টেনে আদর করতে চায় । কিন্তু মেয়েটা মা ঘেঁষা । যেতে চায় না সবার কাছে , কান্নাকাটি করে । তবে মিলির সাথে তার ভাল বন্ধুত্ব ।

মিলির ঘরের সব জিনিসপত্র উল্টিয়ে পাল্টিয়ে লণ্ডভণ্ড করে । কাপড়ের স্থুপে গড়াগড়ি খায় খেলতে গিয়ে । মেকআপ বক্স দেখলেই মিলিকে কখনও চিল্লিয়ে কখনও ইশারায় বুঝাবে তাকে সাজিয়ে দিতে । না করে দিলে কান্না জুরে দেয় । ঘুরতে ঘুরতে কখনো হাতের কাছে মেকআপ বক্স পেয়ে গেলে আর কথাই নেই। নিজেই সেজে চেহারা পাল্টিয়ে ফেলে ।

তখন আয়নায় নিজেকে দেখলে নিজেই ভয় পেয়ে কাঁদে , মিলি হাসে । মেয়েটা বড়ই দুষ্টু । নিতু , একমাত্র মেয়ে মায়াকে নিয়ে থাকছে বান্ধুবি মিলিদের বাসায়। নিতু যখন মায়াকে নিয়ে এ বাড়িতে এসেছিল তখন মেয়েটার বয়স ছিল মাত্র আট মাস । চোখের পলকে কতটা সময় কেটে গেছে কেউ বুঝতেই পারেনি ।

.

ছোট্ট মায়াকে অনেক পছন্দ করে রবিন । বাহিরে গেলে মেয়েটার জন্য এটা ওটা কিনে আনে। বাসায় থাকলে সারাটাক্ষন মায়ার সাথে দুষ্টুমি করার ফন্দি আঁটে । কিন্তু মায়া রবিনের কাছে আসেনা । দূর থেকে দেখে মিটি মিটি হাসে । পা টিপে আলতো করে হেটে রবিনের রুমের বাইরে গিয়ে দাড়িয়ে থাকে । আরাল থেকে চুপি দিয়ে তাকিয়ে থাকে ।

রবিন কখনো ধরে ফেললে প্রথমে হি হি করে হাসে তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে হুট করেই চিৎকার করে কেঁদে দেয় । কোলে নিতে চাইলে আসতে চায় না , কান্নার ভান করে। মায়ের কোলে গিয়ে আবার ফিক করে বুড়ো মানুষের মত করে হাসে । হাসলে তার সামনের উপরনিচ পাটির মাড়িতে ওঠা গুটিকয়েক দাঁত ভেসে থাকে। এতটুকু বয়সে কিনা ভাল অভিনয় করতে জানে মেয়েটা।

রবিনের খুব ভাল লাগে মায়ার সব কাণ্ড কারখানা । অন্যরকম অনুভুতি অনুভব করে সে , স্বর্গীয় অনুভুতি। ইচ্ছে হয় মেয়েটাকে কাঁধে তুলে ঘুরে বেড়াতে , ছোট ছোট আঙ্গুল গুলো ধরে হাটতে , কোন কিছুর বায়না ধরলে তা পূরন করতে, মেয়েটার খেলার সঙ্গী হতে, ব্যথা পেয়ে কান্না করলে মেয়েটাকে শান্ত করতে যেন রবিনই মায়ার বাবা । মায়া হাসলে মনের মধ্যে যেমন শান্তি কাজ করে , তেমনি কান্না করলে অস্থির লাগে । মেয়েটাকে দেখলে কেন যেন নিজের মধ্যে পিতৃত্ববোধ কাজ করে রবিনের।


দ্বিতীয় বিয়ে করার পর থেকে স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা থাকেন রবিনের বাবা । আলাদা পরিবার নিয়ে থাকলেও রবিনদের জন্য সকল ব্যবস্থাই করেন তিনি , অপূর্ণতা রাখেন না । তবে সেসব নিতে নারাজ রবিনের মা । স্বাভাবিকভাবেই ঘৃণা কাজ করে উনার মধ্যে । আশেপাশের প্রতিবেশীসহ অনেক আত্মীয় সেসময় নাক ছিটকিয়েছিল বিয়ের খবর শুনে ।

“স্ত্রীর দোষ না থাকলে কি লোকে দ্বিতীয় বিয়ে করেএএ ! হ্যাঁ ? নিশ্চয়ই ভেতরে কোন রহস্য রয়েছে বলে দিচ্ছি , এক হাতে কখনও তালি বাজে না ! ” একক ভাবে জোহরা বেগমের ওপর দোষ পড়তে থাকে যা তাকে বিষিয়ে তোলে । কখনো কখনো এক হাতেও তালি বাজে , তবে সেটা শ্রুতিমধুর না । মানুষ যে প্রতিনিয়ত নিজের থেকে অন্যকে নিয়ে নেতিবাচক চিন্তায় ব্যস্ত এবং তা যে সম্পূর্ণভাবে অন্যের সত্ত্বাকে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে চলেছে সে বিষয়টা তাদের বোধগম্য না ।

কখনও বোধগম্য হলেও তাকে পাশ কাটিয়ে পৈশাচিক আনন্দটাকে জিইয়ে রাখে কারন মনুষ্যজাতির বোধশক্তি নষ্টের পথে । সমাজের কিছু অংশ ভেঙ্গে পরা মানুষকে কখনো জোড়া লাগতে দেয়না । তারা তাকে ভাঙ্গতেই থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত সে মহাকালে মিশে যায়। জোহরা বেগম ভেঙ্গে না পড়ে বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নেন , মনকে শক্ত করেন । প্রতিকুলতা ছাপিয়ে পরিবারের হাল ধরেন ।

একটি এনজিও চালাচ্ছেন তিনি , যারা নারীর উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে। যে সম্পর্কের আন্তরিকতা নেই , সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার অর্থ নেই । জোহরা বেগম তার স্বামীর সাথে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন । তিনি তার মুখ পর্যন্ত দেখতে চান না । ছেলেমেয়েকেও নিষেধ করে দিয়েছেন যাতে তারা তাদের বাবার বিষয়ে তার সাথে কিংবা তার সামনে কোন প্রসঙ্গ না তুলে এবং কোন প্রকার আলোচনা না করে । তবে তিনি যেহেতু রবিন মিলির পিতা এবং পিতাসন্তানের একে ওপরের উপর তাদের অধিকার রয়েছে সেহেতু রবিন মিলি চাইলে তারা তাদের বাবার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারে।

নিতু, বাবা মায়ের অতি আদরের একমাত্র মেয়ে । অতি আদরের বলেই তার সব স্বাদআহ্লাদ পুরনে কুণ্ঠিত বোধ করত না তার বাবা-মা। নিতু ধরেই নিয়েছিল রাতুলের সাথে সম্পর্কের বিষয়টাও তারা মেনে নেবেন। নিতুর বাবা প্রথমে অমত করলেও মেয়ের কথা চিন্তা করে পরে যখন খোঁজ নিয়ে দেখেন যে ছেলেটা পুরোই অকালকুষ্মাণ্ড যার ভবিষ্যৎ বলে কিছুই নেই এর উপর সে মাদকাসক্ত , তখনই রেগে ওঠেন মেয়ের উপর ।

এরকম একটা মানুষের সাথে জীবন কাটানোর চিন্তা পরের ব্যাপার , তার সাথে পরিচিতি কিভাবে হল এবং সম্পর্ক কিভাবে রেখে আসছে জানতে চেয়ে বাসায় চিল্লেচিল্লি করেছেন তিনি। নিতু যাতে সেই ছেলের সাথে আর কোন প্রকার সম্পর্ক কেন যোগাযোগ পর্যন্ত না রাখে সাফ বলে দিয়েছেন । নিতু অনেক কান্নাকাটি করে। সারারাত মায়ের কাছে বসে থাকে । বার বার বুঝিয়ে তার কাছে আর্জি জানায় । কিন্তু মা’ও মেয়েকে বুঝিয়ে একি কথাই বলেন । লাগামহীন ঘোড়া দড়ি দেখলেই দৌড়ে পালায় ।

আবেগ মানুষের বোধশক্তি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রন করে। নিতুর আবেগী মন তাকে ভালমন্দ বোঝা থেকে বিরত রাখে। বাসা থেকে পালিয়ে সে চলে যায় রাতুলের কাছে। বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে বহুবার । মাদকাসক্ত রাতুল বারবার নিতুকে ফিরিয়ে দিলেও পরে বাধ্য হয়ে রাজি হয় । নিতুর পালিয়ে যাওয়ার এহেন কাণ্ডে বাবা ক্ষুদ্ধ হয়ে যান । পালিয়ে গিয়ে তার ও পরিবারের সম্মানহানি করায় মেয়ের কোন খোঁজ নেননি ।

তবে নিতুর মা বহু চেষ্টা করেছেন মেয়েকে খুঁজে বের করতে । মেয়ের চিন্তায় ভেঙ্গে পরেন তিনি । বিবাহিত জীবন সুখকর ছিলনা নিতুর । রাতুলের ছন্নছাড়া জীবন , পরিবারের প্রতি দায়িত্বহীনতা আর অভাবের দৈন্যতা তাকে ভাবিয়ে তোলে। বিয়ের আগে তাদের জীবন এবং সম্পর্ক কেমন ছিল এসবের দোহাই দিয়ে রাতুলকে বর্তমান অবস্থা পাল্টানোর কথা বোঝানোর চেষ্টা করলে নিতুর ওপর শারীরিক আর মানসিক অত্যাচার নেমে আসত ।

নিতু কখনও ভাবেনি জীবনের গতি এতটা পাল্টে যাবে , তবুও যতটুকু পেরেছে ভালবাসায় রাতুলকে আবদ্ধে রেখে জীবনটা গুছানোর চেষ্টা করেছে । দুঃখকষ্টে জর্জরিত নিতু এর মধ্যে কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় । মায়ার জন্মের পর ঘাড়ে দায়িত্ব পড়ায় ঘাবড়ে যায় রাতুল । বেকার মাদকাসক্ত রাতুল ধারদেনা করে কিছুদিন কোনরকমে পরিবার চালালেও শেষ পর্যন্ত সামলাতে না পেরে নিতু আর মায়াকে রেখে পালিয়ে যায় ।

দিনের পর দিন অপেক্ষায় থেকে ঘোর অন্ধকার দেখতে থাকা দিশাহীন নিতু কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বাবা-মা’র অমতে পালিয়ে বিয়ে করেছিল । দুঃখী মেয়েটা বাবা মায়ের সামনে মুখ দেখাতে পারবেনা বলে না পেরেছে তাদের কাছে ফিরে যাবার সাহস করতে , না পেরেছে রাতুলের অপেক্ষায় থেকে জীবন সংগ্রাম করতে ।

এদিক অদিক কিছুদিন থেকে সে যোগাযোগ করে মিলির সাথে , তার ছোট বেলার বান্ধুবি । নিতুর জীবনের কথা শুনতে গিয়ে মিলি আঁতকে ওঠে । নিজের ছোট বেলার এত কাছের বান্ধুবির এমন অবস্থা দেখে মিলির নিজেরই কান্না চলে আসে । মিলি তখনই মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে নিতুকে বাসায় নিয়ে আসে । জোহরা বেগম সব শোনার পর নিতুকে কিছু বলেননি।

শুধু বলেন, মিলি যেমন আমার মেয়ে , তার বান্ধুবি হওয়া মানে তুমি আমারো মেয়ে । আর নিজের মেয়ের কষ্ট আমি মেনে নিতে পারিনা ।এটাকে তোমার নিজের বাড়ি মনে করো । মায়াকে নিয়ে তোমার যেভাবে ইচ্ছে , যেভাবে তোমার ভাল লাগে , তোমার মত করে তুমি থাকো ।


বন্ধুবান্ধব নিয়ে এডভেঞ্চারাস ট্যুরে যাওয়া রবিনের অতি পছন্দের কাজ । সময় পেলেই বেরিয়ে পড়ে দেশের এই কোনা থেকে ওই কোনায় । ট্যুরের জন্য কখনও মায়ের কাছ থেকে টাকা নেয়নি রবিন । হাতখরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে , কখনও কন্ট্রাক্টে কারো কাজ করে দিয়ে , কখনও ধারদেনা করে ট্যুরের জন্য টাকা জমা করে । তার মতে, সব ব্যাংকের আলাদা একটা ট্যুর স্কিম খোলা উচিৎ যাতে তার মত ভ্রমনপিপাসী মানুষ লোন নিতে পারে ঘোরাঘুরির জন্য।

একবার এক প্রাইভেট ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল এই বিষয়ে । ম্যানেজার হাসিমুখে তাকে নিজের রুমে নিয়ে খাতির যত্ন করে । ভদ্র লোক যখন জানতে চান যে তিনি কিভাবে তাকে সেবা দিতে পারেন , রবিন জানায় তার ইচ্ছের কথা। “ আসলে আমি ভ্রমনপাগল মানুষ । আমাদের ছোট্ট একটা দল আছে । প্রতি ৩ মাস অন্তর অন্তর আমরা কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাই ।

এখন প্রত্যেকের কোন না কোনবার ট্যুরের টাকা জমানোটা কষ্টকর হয়ে পড়ে , বিশেষ করে আমার কারন আমি বাসা থেকে এর জন্য টাকা নেই না । অনেকেরই এরকম হয় । তখন দেখা যায় হয় একজনের জন্য দলের ট্যুর মিস হয় নয়ত সে দলের সাথে ট্যুরে থাকাটা মিস করে। এখন আর কি আমার মুল কথা হচ্ছে আপনারা যদি আমাদের ব্যক্তিগতভাবে ট্যুর স্কিমের আওতায় ট্রাভেলের জন্য লোনের ব্যবস্থা করে দেন তাহলে অনেক ভাল হয় । ”

ম্যানেজার পাক্কা ২৬ সেকেন্ড রবিনের দিকে তাকিয়ে ছিল একনাগাড়ে । রবিন ঘড়ি ধরে দেখেছে। কখনও কেউ রবিনের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকেনি , রবিনের অস্বস্তি লাগছিল । ভার্সিটিতে জীবনের শেষ বারের মত পরীক্ষা দেবার পর এখন হাতে অফুরন্ত সময় রেসাল্টের আগ পর্যন্ত। আপাতত কোথাও ট্যুর দিয়ে আসা যায় চিন্তা করে রেখেছে রবিন । বন্ধুদের সাথে কথাও পাকাপাকি হয়ে গেছে ।

এবার তাদের গন্তব্য তিন্দু , বিরিশিরি , বগা লেক আর নাফাখুম । বিরতি দিয়ে একেক গন্তব্যে পৌছানোর ইচ্ছা । কিন্তু এর মাঝেও একটা বিষয় বার বার রবিনের মন খারাপ করে দিচ্ছে । ভাবিয়ে তুলছে। অস্থির করে তুলছে তাকে।

মিলিদের বাসায় চলে আসার পর নিজের আর মেয়ের থাকার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তামুক্ত হলেও নিতুর মনে কখনও শান্তি আর স্বস্তি ছিলনা । বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ের জীবনে কোন কিছুরই অভাব ছিলনা । তবে অভাববোধ ছিল তো একজন ভালবাসার মানুষের , যার সাথে বিশেষ মুহূর্তের অনুভুতিগুলো ভাগাভাগি করে নেয়া যায়।

যেকোনো কারনে যেকোনো মানুষকে ভাল লাগতেই পারে । তাই বলে কিছু না ভেবে ভালবেসে জীবনসঙ্গী কিংবা সঙ্গিনী করার সিদ্ধান্ত সমীচীন নয় । ভালবাসার মত পবিত্র অনুভুতি অমূল্য । ভুল মানুষের জন্য সে অনুভুতি প্রকাশ পেতে নেই কেননা একবার সেই অনুভুতিতে নিংড়ানো আঘাত লাগলে তা বিদ্বেষে রুপ নেয়। কখনো এককভাবে আবেগের উপর নির্ভর করতে নেই । কখনও না কখনও সেই আবেগ জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টের কারন হয়ে দাঁড়ায় ।

ভুল মানুষকে জীবনসঙ্গী করার সস্তা আবেগী সিদ্ধান্তই নিতুর জীবনের গতি পাল্টে দিয়েছিল। সারাটা সময় চিন্তায় বিভোর থাকে নিতু । বিকেলের দিকে ছাঁদে উদাসী হয়ে হাঁটে । কখনও সন্ধ্যা নেমে এলেও বিকার থাকেনা । বৃষ্টি নামলে একাই ভিজে । চোখের জল আর বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে যায়। নিতুর এমন উদাসীভাব যে রবিন লক্ষ্য করে নিতু দেখেছে। মানুষটা অনেক ভাল। মায়ার জন্য অনেক দরদ তার ।

বাবা না হয়েও বাবার মত মায়াকে ছোট থেকে আদরে আগলিয়ে রাখছে । রাতুল বাবা হয়েও কখনো এমন করতনা । করত কি করতনা এমন চিন্তা করাও বৃথা । যে মানুষ তার অসহায় স্ত্রী আর ছোট বাচ্চাকে এভাবে একা রেখে পালিয়ে যেতে পারে তাকে শুধু ঘৃণাই করা যায় তাকে নিয়ে কোন কিছু চিন্তা করাও সময় নষ্টের নামান্তর । মায়াটা বড় হচ্ছে। কথা বলা শিখেছে ।

প্রথমবার যখন মা বলে ডেকেছে নিতুর সে যে কি আনন্দ ! ইচ্ছে করেছে বাবা-মা কে জানাতে , মায়ার কণ্ঠে শোনাতে যে সে এখন মা । রাতুল আর মায়াকে জড়িয়ে ধরে রাখতে ইচ্ছে করেছে। কিন্ত ! মিলি বসে বসে মায়াকে কথা বলতে শেখায় । মা , মামা , দাদা , নানা । বাবা শব্দ যখনই বলে মিলি একবার নিতুর দিকে তাকায় । নিতু শাড়ির আচঁলে মুখ লুকায় ।

কান্না কাউকে দেখাতে নেই। নিতু অনেক চেষ্টা করেছিল রাতুলকে সে পথ থেকে ফেরাতে। চেষ্টা করেছিল রাতুলের পরিবার সম্পর্কে জানতে, তাদের সাথে যোগাযোগ করতে। রাতুল কখনই তার পরিবার সম্পর্কে বলতে চাইতনা । বাবা-মা’র কথা না শুনে , রাতুল সম্পর্কে না জেনে , না বুঝে নিতু যে কত বড় ভুল করে ফেলেছে যার প্রায়শ্চিত্ত তার জানা নেই।

মনটা একেবারেই মরে গেছে । প্রতি রাতেই নিতু অনুশোচনায় কাঁদে । নিঃশ্বাস তো কোমাতে থাকা মানুষরাও নেয় । তাই বলে কি বলা যায় তারা পূর্ণভাবে বেঁচে আছে ? মানুষ পূর্ণভাবে বেঁচে আছে এর প্রমান তার মনের শিহরন । মনের শিহরণ না থাকলে হয় সে বয়সের আগেই বুড়িয়ে গেছে নয় সে জীবনমৃত, যা তাকে প্রতি পদে অন্তর্ঘাতে ভোগাবে।


রবিন কখনও নিতুর সামনে আসেনা । যদি কোন কিছুর দরকার পরে তাহলে মিলিকে বলে। মিলি বাসায় না থাকলে মা’কে বলে। মা নিতুকে বলে দেন । নিতুও মাঝে মাঝে নিজ থেকেই করে দেয় । কোন কিছু না পেলে খুঁজে দেয় । রবিনের প্রতি ভাল লাগা থেকেই নিতু কাজ গুলো করে , করে দিতে তার ভাল লাগে । রবিনের ভাল লাগে বিষয়গুলো । নিতুর প্রতিও তার ভাল লাগা কাজ করে , তবে কিছু বলেনা । কারন ভাল লাগার সাথে অস্বস্তি লাগারও কারন আছে । সমাজভীতিটা প্রকটভাবে কাজ করে রবিনের মাঝে।

বহুবার চিন্তা করার পর নিতু সিদ্ধান্ত নেয় তার মায়ের সাথে যোগাযোগ করার। বাবার সাথে কথা বলার সাহস তার নেই । অনেকদিন হয়ে গেছে , এভাবে অন্যের পরিবারে বোঝা হয়ে থাকাটা আর ভাল লাগছেনা । মিলির পরিবারের সদস্যরা অনেক ভাল । মা , মিলি আর রবিন ।

জীবনের দুঃসময়ে তারা যেভাবে পাশে থেকেছে, যেভাবে সাহায্য করেছে , মায়াকে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রেরনা জুগিয়েছে তার জন্য নিতু আজীবন কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি। নিতু তার মায়ের সাথে যোগাযোগ করে ফোনে । বহুদিন পর মেয়ের কণ্ঠ শোনার পর মা কেঁদে ফেলেন । জানতে পারেন তার আদরের মেয়ে কোথায় আছে , কেমন আছে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে নিতুর কাছ থেকে ঠিকানা জেনে সোজা চলে আসেন মেয়ে আর নাতনীকে দেখতে ।

ঠুকরে কেঁদে ওঠেন মেয়ের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরে। জোহরা বেগম সামলান নিতুর মা’কে । নাতনীকে কোলে নিয়ে আদর করেন মহিলা । নিতুকে কথা দিয়ে যান তিনি অবশ্যই আজ ফিরে গিয়ে নিতুর বাবার সাথে কথা বলবেন । মেয়ের হয়ে তার কাছে মাফ চাইবেন । তাকে মানিয়ে মেয়ে আর নাতনীকে শিগ্রই বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।

মায়ার প্রতি রবিনের টান আগের থেকে আরও বেশি বেড়ে গেছে। রহস্যজনকভাবেই ৩ দিন আগে মেয়েটা রবিনের রুমে এসে খেলা করেছে । রবিন তাকে কোলে নিয়েছে , কাঁধে উঠিয়ে ঘুরিয়েছে কিন্তু মেয়েটা মোটেও কাঁদেনি । খিলখিল করে হেসেছে । রবিনের আনন্দের সীমা ছিল না । আবেগাক্রান্ত রবিন মায়াকে দিয়ে বহুবার চেষ্টা করেছে তাকে বাবা ডাক বলাতে । কিন্তু মায়া বলেনি , চুপ করে ছিল ।

মিলির কাছ থেকে যখন জানতে পারে নিতু আর মায়া চলে যাচ্ছে তখন থেকেই তার মনটা খারাপ। এতদিনের বন্ধন ছিন্ন করে নিতু আর মায়া চলে যাচ্ছে মানতেই কষ্ট হচ্ছে তার । ট্যুরেও যাবেনা বলে বন্ধুদের মানা করে দিয়েছে । সারাদিন ঘরেই বসে থাকে। মায়ার সাথে খেলা করে । যতটুকু সম্ভব মায়ার সাথে শময় কাটানোর চেষ্টা করে । কে জানে কখনো আবার মায়াকে দেখতে পাবে কিনা , কাছে টেনে বাচ্চাটাকে আদর করতে পারবে কিনা । মনে হলেই কান্না চলে আসে ।


আজ চলে যাচ্ছে নিতু আর মায়া । নিতুর বাবা মেয়েকে মাফ করে দিয়েছেন । তিনি স্ত্রীকে নিয়ে মিলিদের বাড়ি এসেছেব নিতু আর মায়াকে নিয়ে যেতে । নিতুর আজ মনটা খুব ভাল লাগছে তবে খারাপও লাগছে সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে । নিতু ব্যাগ গোছাচ্ছে আর মিলি মায়াকে তৈরি করে দিচ্ছে । রবিন ঘরে বসে আছে । মন এতটাই খারাপ যে নিতুর বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে পর্যন্ত যায় নি।

হাহাকার লাগছে মনের ভেতর । জোহরা বেগম ড্রয়িংরুমে বসে আছেন নিতুর বাবা মায়ের সাথে , কথা বলছেন পুরনো দিন নিয়ে । মায়ার বড় হওয়া , প্রথম হাঁটতে শেখা , কথা বলা , মায়ার দুরন্তপনা আর দুষ্টুমি , সবাইকে এক করে মহামায়ায় আবদ্ধ রাখা ! নিতু মায়াকে নিয়ে বেরিয়ে আসে । জোহরা বেগম ছোট্ট মায়াকে জড়িয়ে থাকেন কিছুক্ষণ । তারও মনটা খারাপ ।

এতদিন ঘরটাকে আলোকিত করে রাখা বাচ্চাটা চলে যাচ্ছে আজ । আজ থেকে ঘরটা শুন্যতা বোধ করবে । চলে যাবার আগে নিতু সবার থেকে বিদায় নিল। চোখের জলে কৃতজ্ঞতা জানালো দুঃসময়ে পাশে থাকার জন্য। নিতু দেখল রবিন ড্রয়িং রুমে নেই । নিতু ঘরটার দিকে চোখ বুলালো একবার । বুলানোর সেই দৃষ্টিতে ছিল ঘরের কোন এক কোনায় দাড়িয়ে থাকা রবিনকে এক পলক দেখার ইচ্ছা ।

মায়া হন্য হয়ে কি যেন খুঁজছে , ঘরের এদিক ওদিক তাকাচ্ছে । মিলি দৌড়ে গেল রবিনের রুমে । মায়াকে একবার দেখার জন্য আর তাদের বিদায় দেবার জন্য রবিনকে অনেক করে বলল ড্রয়িং রুমে আসতে , রবিন আসতে চাইলনা । মিলি জানে রবিন নিতুকে পছন্দ করে। মায়াকে নিজের মেয়ে ভাবে , অনেক ভালবাসে । মিলি রবিনের চোখটা ছলছল করতে দেখল যেখানে রয়েছে লাল আভার উপস্থিতি।

মিলি চলে গেলে রবিন আস্তে করে উঠে দাঁড়ায় । দরজা পাশে এসে দাঁড়ায় , মায়ার মত করে একটু বেশি ঝুঁকে আরাল হয়ে দাঁড়ায় । দেখে , মায়া চলে যাচ্ছে মায়ের হাত ধরে । বের হবার সময় নিতু মায়াকে বলে , “হাত নাড়িয়ে বিদায় নাও ! বাই বলো সবাইকে ! বলো আমাদের বাসায় বেড়াতে আসবেন !” মায়া রবিনকে দেখতে পায় , খুশি হয়ে ওঠে মেয়েটা । তার গুটিকয়েক দাঁতগুলো মেলে হাসি দেয়। হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে ওঠে , বাবা !!! চমকে ওঠে সবাই ।

সবাই তাকিয়ে থাকে রবিনের দিকে । নিতু তাকিয়ে দেখে রবিন এগিয়ে আসছে , চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে ।নিতুর বাবা-মা বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন রবিনের দিকে । রবিন নিতুর সামনে এসে দাঁড়ায় । মিলি দেখল নিতুর চোখের কোনায় জল । মিলি মায়াকে কোলে তুলে নেয় । ব্যাগ নিয়ে সোফার পাশে রাখে । রবিন একবার তার মায়ের দিকে তাকায় । মা তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে , মুচকি হাসি দেন তিনি । রবিন নিতুর দিকে তাকায় ।

নিতুর হাত ধরে বলে , “নিতু ! আমি এতদিনের বাধন ছিন্ন করে তোমাকে আর মায়াকে ছাড়া থাকতে পারব না । আমি মায়া আর তোমাকে নিয়ে আজীবন মহামায়িক বাঁধনে বেঁচে থাকতে চাই । মায়া আর তোমার জীবনে পূর্ণতা আনতে চাই । আমার আমার পরিবারকে ছেড়ে প্লিজ তোমরা চলে যেওনা । মায়াকে আমার আর আমার পরিবার থেকে প্লিজ তুমি আলাদা করোনা । পরিপূর্ণভাবে আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে যাও ! আমাকে আর আমার পরিবারকে আপন করে নাও ! ” রবিন দেখল নিতুর চোখ বেয়ে পানি ঝরছে । “ নিতু ! আমি মায়ার বাবা হতে চাই ! ”

ঘরের উপস্থিত মানুষজনের চোখের কোনায় জল চলে এসেছে , এমনকি নিতুর বাবা মায়েরও। মায়াসহ ঘরের সবাই তাকিয়ে আছে এই দুই মানব মানবীর দিকে । রবিন আর নিতু একে অপরের হাত ধরে কাঁদছে ।

লেখক : মঈন উদ্দিন সাব্বির (Moin Uddin Sabbir)

শূন্যতার শুকতারা

: সার্জারির এসোসিয়েট প্রফেসর ডাঃ এস আহমেদ বারের এক কোণে বসে আছেন, সামনে স্কচের বোতল। গ্লাসে দু'কিউব বরফ রাখতে রাখতে তার অহনার কথা মনে পড়ে গেল। অহনা এইভাবে কোক খাওয়ার আগে আইস-কিউব রাখতো, তারপর এক টুকরো লেবু দিত, শেষে ধীরে ধীরে কোক ঢালত। তখন তিনি শুধুই সুলতান, ডাঃ সুলতান আহমেদ হওয়ার বহু আগের কথা। অহনা তখন হোম ইকোনমিক্সে পড়ে। ঢাকা মেডিকেল থেকে নীলক্ষেতের মোড়ে এসে সুলতান দাঁড়াত, হোস্টেল থেকে এসে অহনা কখন পাশে দাঁড়াবে এই অপেক্ষায়। তারপর দুজন মিলে রিকশায় ঘোরাঘুরি, ফুচকা-চটপটি, একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা, বৃষ্টির জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, অস্ফুটস্বরে বলা 'ভালোবাসি' ...

সুলতান এমবিবিএস পাশ করার আগেই অহনার বিয়ে হয়ে যায়, পাত্র পুলিশ অফিসার। তখনকার সময়ে প্রেম শব্দটা তেমন একটা গুরুত্ব পেত না মুরুব্বিদের কাছে, তাদের কাছে পাত্র কি চাকরি করে সেটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মোবাইল সে যুগে ছিল না, অহনাদের বাড়ির ল্যান্ডফোনে কয়েকবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায় নি।

সুলতান অহনাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান দেখল, বড় বড় গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। হাজারো মানুষের ভিড়ে একজন নগণ্য দর্শকের মত দাঁড়িয়ে অহনার বিদায় দৃশ্য দেখল সুলতান। দূর থেকে অহনাকে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না সেদিন। অহনা কাঁদছিল অঝোর ধারায়, হতভম্ব সুলতান বুঝে উঠতে পারছিল না এই কান্না একটা মেয়ের নিজের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার, নাকি ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে অন্যের ঘরণী হওয়ার।

.

সেটা জানার সুযোগ আরেকদিন এসেছিল। বছরখানেক পরে, সুলতান তখন ইন্টার্ন ডাক্তার। ওটি শেষে কলিগ দেবাশীষকে নিয়ে নিউমার্কেটে এসেছিল কি একটা কাজে, হঠাৎ অহনার সাথে দেখা। অহনার হাতে ব্যাগ, শাড়িপড়া অহনার সামনে পড়ে সুলতান বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। অহনা মাথা নিচু করে হেঁটে চলে গিয়েছিল সেদিন। দেবাশীষ সুলতানকে জিজ্ঞেস করেছিল,'তুই ওর সাথে কথা বললি না কেন? তোকে ছেড়ে গেল কেন সেটা শুনবি না?'

সুলতান আনমনে উত্তর দিয়েছিল, 'সেকথা জেনে কি হবে রে... ও সুখী আছে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করা যেত... ওকে পেতে চাওয়াটা ছিল ক্ষুদ্রতা, এরচেয়েও অনেক বেশি জরুরী ছিল ওর ভালো থাকা... '

দেবাশীষ কথা বাড়ায় নি, হয়তো পুরনো ক্ষত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায়নি।

এরপর বহু বছর কেটে গেছে। ছোট ভাইবোনদের মানুষ করার তাগিদে চাকরি করতে হয়েছে, ডিগ্রী করতে হয়েছে। তিন বছর আগে ছোট বোনটার বিয়ে দেয়ার পর থেকে সুলতান সাহেবের দায়বোধ অনেকটা কমেছে। অবিবাহিত থাকায় আর কোন পিছুটানও নেই। জীবন বা ক্যারিয়ার নিয়ে কোন উচ্চাশা তো দূরের কথা, নূন্যতম চিন্তাও সুলতান সাহেবের মাথায় নেই।

বয়স পঞ্চাশ পার হলেও দেখলে মনে হয় আরও বেশি, ড্রিঙ্ক করার অভ্যেসটা কি চেহারার উপর বয়সের ছাপ ফেলে দেয়? 'এজিং ফিজিওলজি' নিয়ে প্রফেসর শরাফাতের সাথে কথা বলা দরকার, নিঃসঙ্গ সুলতান সাহেবকে মাঝেমধ্যে বারে সঙ্গ দেয় শরাফাত। আজ অবশ্য শরাফাত কাছে নেই, জেলা শহরের নতুন মেডিকেল কলেজের মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান হওয়ায় শরাফাতের প্র্যাকটিস এর মধ্যেই বেশ জমে উঠেছে। মানুষের জীবনে ব্যস্ততা এক অদ্ভুত জিনিস, নিমেষেই বন্ধুবান্ধবদের থেকে আলাদা করে দেয়।

হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। সার্জারির এসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার শামস কল করেছে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফোনটা রিসিভ করতেই শামসের উদ্বিগ্ন গলা শোনা গেল,'স্যার, একটু ঝামেলা হয়েছে...'

সুলতান সাহেবের চতুর্থ পেগ শেষ হয়েছে, এখন পঞ্চম পেগ চলছে। তিনি কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললেন,'হ্যাঁ বলো শামস, কি ব্যাপার?' 'স্যার, নীলগঞ্জে নির্বাচন নিয়ে মারামারি হয়েছে। পুলিশসহ ১৭ জন আহত, তার মধ্যে ৫ জন গুলিবিদ্ধ। রফিক স্যার একটা ওটিতে দাঁড়িয়ে আছেন, আমরা বাকিগুলো দেখছি কিন্তু স্যার দুটো খুবই কমপ্লিকেটেড কেস, গুলি সম্ভবত হার্টে লেগেছে। স্যার আপনি না আসলে আমরা সাহস পাচ্ছি না...'

সার্জারির কনসালটেন্ট রফিকসহ অন্যরা মিলেই সাধারণত অপারেশন থিয়েটারের রুটিন কাজকর্ম করে, সুলতান সাহেব একাডেমিক কার্যক্রম দেখেন। রোগী দেখা কিংবা চেম্বার করা- এসব ব্যস্ততা তার ভালো লাগে না। ছেলেমেয়েদের পড়িয়ে নিজের নিঃসঙ্গতা কাটানোর চেষ্টা করেন, খুব ঝামেলার অপারেশন হলে একটু গাইডলাইন দেন, কিংবা সুপারভাইজ করেন- এর বেশি না। বেশ কয়েক বছর ধরেই সুলতান সাহেব লক্ষ্য করেছেন, তার Intention Tremor তৈরি হয়েছে, ভেবেচিন্তে কিছু করতে গেলেই হাত কাঁপে। সার্জন হিসেবে এটা একটা বিশাল দুর্বলতা, তবে রোগী নিয়ে কাজ কমিয়ে দেয়ায় সুলতান সাহেব কিছুটা নির্ভাবনায় আছেন।

এখন পঞ্চম পেগের মধ্যে হাসপাতালে যাওয়া ঠিক হবে কিনা সেটা নিয়ে সুলতান সাহেব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। সংশয়ের মধ্যে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন, কর্তব্য এড়ানো যায় না, অন্তত সুলতান সাহেব জীবনে কখনো কর্তব্য এড়াননি। --------------

সার্জারি ওয়ার্ডে উপচে পড়া ভিড়। ঠেলেঠুলে ওয়ার্ড পার হয়ে সুলতান সাহেব ওটির কাছে চলে গেলেন, সেখানেও ভিড় কম না। ডাক্তারদের চেঞ্জরুমে গিয়ে সবুজ গাউন আর মাস্ক পড়ে বের হওয়ার সময় এনেস্থেশিয়ার জুনিয়র কনসালটেন্ট জব্বারের সাথে দেখা।

'স্যার চলে এসেছেন? যা ঝামেলা হচ্ছে। আজ রাতের কাহিনী লিখে রাখার মত,বুঝেছেন... এক গ্রুপ ইলেকশন নিয়ে হাঙ্গামা শুরু করেছে, আরেকগ্রুপ গোলাগুলি শুরু করেছে... দুপক্ষের লোকজনের সাথে পুলিশও কম খায়নি, এসপি এসআই-সহ তিনজন আহত... এসপিকে মনে হয় বাঁচানো যাবে না... আপনি একটু দেখেন... ঢাকায় রেফার করবেন কিনা... স্যার, আমি কিছু জিনিসপত্র আনতে নিচে যাচ্ছি... একটু পরেই ওটিতে আসছি...'

'যাও... আর শোনো, আমার গাড়ি পারকিং লটে আছে... ড্রাইভারকে বলবে আমার সিগারেটের প্যাকেটটা দিতে... সারারাত জাগা লাগবে কিনা কে জানে...'

জব্বার বের হবার পর সুলতান সাহেব ওটির ভেতরে ঢুকলেন, ঠিক ঢোকার পথে গেটের পাশেই পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন।

এই মুখ হাজার বছর পর দেখলেও তিনি ভুল করবেন না।

কিন্তু ও এখানে কেন? টলতে টলতে সুলতান সাহেব ওটিতে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিলেন। উদ্বিগ্নমুখে শামস ছুটে এলো,'স্যার এসপি সাহেবের অবস্থা একটু দেখেন, এ্যাম্বুলেন্স রেডি আছে, আপনি বললেই ঢাকায় রেফার করে দিচ্ছি, আমাদের এই সাপোর্টে কার্ডিয়াক সার্জারি তো হবে না...'

সুলতান সাহেব ওটি টেবিলের পাশে দাঁড়ালেন। মানুষটাকে আগে কখনো দেখেননি, তবু অদ্ভুত একটা অনুভূতি সুলতান সাহেবকে আচ্ছন্ন করল। পালস দেখে শামসকে বললেন,'এই রোগী ঢাকায় নেয়ার আগেই মারা যাবে, হয় এখনি কিছু করতে হবে, নাহলে...' 'তাহলে কি করব স্যার...' 'তিনজন এসিস্ট্যান্ট দাও... এক্ষুনি...'

সুলতান সাহেবের গলার স্বর শামসের কাছে অদ্ভুত শোনাল। স্যার তো সাধারণত এভাবে কথা বলেন না। শামস দ্রুত ওটির জন্য প্রস্তুত হতে লাগলো।

সুলতান সাহেবের মাথায় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অহনার হাসি, কাঁটাবনের ফুলের দোকান, ঢাকা মেডিকেলের ইন্টার্ন হোস্টেলের বিনিদ্র রাত, এফসিপিএসের গোল্ড মেডেলের গায়ে জড়ানো ধুলো, স্কচ-হুইস্কির শূন্য বোতলে নিজের প্রতিচ্ছবি আরও কত কি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে... মাথার ভেতর পিজি'র বিখ্যাত প্রফেসর রহমান সাহেবের গমগমে কণ্ঠ বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে-'it's not you fighting on the battlefield, but a soul praying to the almighty... সেবা জিনিসটারে প্রফেশন বানায়ো না বাবা, এইটা তোমার ধ্যান, এইটা তোমার ইবাদত... যত গভীরে তুমি যাবা, ঈশ্বর তোমার তত কাছে আসবে...' সুলতান সাহেব দ্রুত হাত লাগালেন, তাকে ধ্যানের খুব গভীরে যেতে হবে, অন্ধকার এক অনন্তের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা চাইবেন তিনি... কারো সুখের জন্য পুরনো সুরে নতুন একটি প্রার্থনা...

সার্জারির ডাক্তার, অটিবয়, নার্সরা এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। এসোসিয়েট প্রফেসর এস আহমেদের tremor-এ ভোগা হাতদুটো ইস্পাত কঠিন হয়ে ওটি টেবিলে বিচরন করছে, হাতের কাজ দেখে মনে হচ্ছে কোন এক দক্ষ কারুশিল্পী তুলির আঁচড় দিচ্ছেন পরম মমতায়। এস আহমেদ সাহেবের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, কিন্তু কেউ সাহস করে চোখ মুখে দিতে পারছে না। ওটিতে কারো গায়ে হাত দেয়ার নিয়ম নেই, আর এভাবে সার্জনের কাঁদার কোন ইতিহাসও নেই। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটার এই রূপ কেউ কোনদিন দেখেনি।

সিগারেটের প্যাকেট হাতে জব্বার শামসের পাশে এসে দাঁড়ালো, জিজ্ঞেস করল,'কি অবস্থা?'

শামস উত্তর দিল না। যদি এই অপারেশন সাকসেসফুল হয়, তাহলে এটা হবে এই হাসপাতালের ইতিহাসের প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি।

সাড়ে তিন ঘণ্টা পরের কথা। পোস্ট-অপারেটিভ বেডে এসপি সাহেবকে নেয়া হয়েছে,পালস-বিপি ইমপ্রুভ করছে।

সুলতান সাহেব হাসপাতালের ছাদে এসে দাঁড়ালেন, মার্লবোরো সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। বহু বছর আগে একটি মেয়ে তাকে তারা দেখা শিখিয়েছিল... লুব্ধক, শুকতারা, সপ্তর্ষি- আরও অনেক তারা-ছায়াপথের নাম জানত মেয়েটি।

আকাশের দিকে তাকিয়ে সুলতান সাহেব লুব্ধক খোঁজার চেষ্টা করলেন, কিন্তু খুঁজে পেলেন না।

আকাশের ঐ তারার মত জীবনের অনেক কিছুই তিনি খুঁজে পাননি, তবু ভেজা চোখে আকাশপানে তাকিয়ে থাকেন... নীরবতায়... প্রার্থনায়... শূন্যতায়...

লেখক : মাহবুব হোসেন