পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৪

এক অসহায় বাবা বলছি


ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি বাবা-মেয়ে। একটা সময় বুকটা ধক করে উঠলো। পিচ্ছিটার ডাকে আমার লেগে লেগে আসা ঘুমটাও ভেঙ্গেগেছে। চোখ কুচকে জিগেস করি,"কি হয়েছে মামুনি?"

"বাবা,মায়ের শাড়িটা উঠোনে ভিজে যাচ্ছে, নিয়ে আসি?"- আমার মেয়ে বলে উঠে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি,"না থাক,ওটা ওখানেই থাকুক"। পিচ্ছিটা বলে,"বাবা,মায়ের তো আর শাড়ি নেই। কাজ থেকে এসে কি পরবে?"

ক্রাচে ভর দিয়ে বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করি। আমার মেয়ে ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে আমার বাহু আকড়ে ধরে। "বাবা,তুমি উঠোনা,আমি নিয়ে আসছি "-আমাকে কাতুর কন্ঠে বলে।

-তুমি নাগাল পাবে না তো মা।

-আমাদের বাইরে একটা ভাঙা চেয়ার আছে বাবা,ওটাতে উঠে দড়ির উপর থেকে মায়ের শাড়ি নিয়েয় আসবো।

আমি চুপ থেকে সম্মতি জানাই। এই মুহুর্তে আমার আদরের মেয়েটিকে,আহ্লাদের মেয়েটিকে আমি বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।যদি চেয়ার থেকে ও পিছলে পড়ে যায়! ভাবাচ্ছে আমাকে। কিন্তু আমার কিছু করার নেই।

মেয়েটা আস্তে আস্তে এগুতে থাকে। উঠোনে বৃষ্টির ফোটা পড়ছে। মাটিগুলো সরে যাচ্ছে। আমার মেয়ে ধীরে ধীরে চেয়ার টা নেয়। প্লাস্টিকের চেয়ার। চেয়ারের দুটি হাতল ধরে উঠার চেষ্টা করে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বুকটা কেমন যেন ধক করে উঠে। যদি ও পড়ে যায়?

একটা সময় প্রচন্ড বাতাস আসে। পিচ্ছি মেয়েটার মাথার চুলগুলো উড়তে থাকে। এবার মেয়েটা চেয়ার এর উপর উঠতে পারে। আমার বুকের ভেতর প্রচন্ড একটা ব্যাথা হচ্ছে। আমার হৃদপিন্ডের অর্ধেকটা জুড়েই যে আমার মেয়ে!

বৃষ্টির ফোটায় উঠোনের মাটি সরে যায়।ক্রমশ বাতাস বইতে থাকে। একটা সময় দুঃস্বপ্নের মতো আমার মেয়েটা চেয়ার থেকে পড়ে যায়। হাটুতে চেপে ধরে কান্না করে। "বাবা" বলে চিৎকার করে। আমার চোখের সামনেই। আমার পরীর মতো মেয়েটার গায়ে কাদা লেগে যায়।ব্যাথায় কাতরাচ্ছে সে।ক্রাচটা খাট থেকে মোটামুটি দুরে। আমি আজ এমনই এক হতভাগা বাবা যে নিজের মেয়েটাকে পর্যন্ত আগলে রাখতে পারলাম না। এমনই হতভাগা বাবা যে আমার চোখের সামনে আমার মেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কাদছে। গায়ে কাদা মাটি মাখছে। দু হাত তুলে আল্লাহর কাছে বলি,"আল্লাহ,আমাকে দুটা মিনিটের জন্য শক্তি দাও,দয়া কর আল্লাহ! "

সৃষ্টিকর্তাটাও তখন বড় নিষ্ঠুর হয়ে যায়। ইচ্ছে করেই বৃষ্টির শব্দ বাড়িয়ে দেয় যেন আমার চিৎকার যমীন থেকে আসমানে না পৌছায়। যেন আমার মেয়ের চোখের পানি আর বৃষ্টির পানি আলাদা করে না দেখা যায়!

আমি কাদতে থাকি। আমি উঠতে পারিনা। এ দেহে প্রাণ আছে কিন্তু প্রাণের সঞ্চার নেই। আমার অবুঝ মেয়েটা বুঝে যায়,তার বাবা তাকে বাচানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। হামাগুড়ি দিয়ে আমার কাছে আসে। গায়ে কাদা নিয়েই আমার বুকে এসে পড়ে। সেই কাদা নিয়েই আমার ক্লান্ত মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ে। ব্যাথায় কাতুর মেয়েটা একটি বারের জন্য ও বলেনি সে ব্যাথা পাচ্ছে খুব। শুধু জানতে চাচ্ছিলো, তার মা কখন আসবে। হয়তোবা মেয়েটি জানে,তার বাবা আজ কিছু করতে পারবে না তার জন্য। আজ না শুধু,চিরজীবনের জন্য!

এক বছর ধরে শরীরের বাম পাশ প্যারালাইজড। না পারি হাটতে,না পারি চলতে। মাঝে মাঝে নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে বড় অমানুষ মনে হয়। আমি না একজন আদর্শ স্বামী,না একজন আদর্শ বাবা!

গত বছর থেকে আমি অসুস্থ্য। সংসারের চাকাটা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। যেদিন শেষ আধা কেজি চাল ভাতের পাতিলে ঠাই পায় সেদিন আমার বউ এর মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। পাতিল থেকে মাড় ঝরানোর সময় আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো উদাস নয়নে। ঠিক তখনই আমার বউ এর মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে চাকুরী পায় সে। অভাবের মুখটা না দেখতে হলেও উচ্চমধ্যবিত্তের সুখটা আর পাওয়া হয়নি।

সেদিন থেকে শুরু হয় এক পরিশ্রমি,এক সংগ্রামী নারীর গল্প। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাচটা পর্যন্ত স্কুল করিয়েও যখন মাস শেষে অনেক বিশাল খামের ভেতর চার পাচটা পাচশো টাকার নোট সুখ আনতে পারেনা তখন সিদ্ধান্ত নেয় টিউশানির। ভোরে,খুব ভোরে পঙ্গু স্বামী আর ছোট্ট মেয়েটার জন্য রান্না করে মেয়েটি। পাতিল ঘসতে ঘসতে ফর্সা হাতটা যখন কালো হয়ে যায়, সেই কালো হাত ঘসে মেজে ধুয়ে আমাদের বাবা-মেয়েকে উঠিয়ে দেয়। খাইয়ে দাইয়ে প্লেট,পাতিল ধুয়ে দিয়ে সে চলে যায় তার কাজে।

পঙ্গুত্ব বরণ করার পর থেকে আমি এই মেয়েটার মাঝে অস্বাভাবিক মানসিক পরিবর্তন দেখি। রাগী,জেদি মেয়েটা যেন মুহুর্তেই বুঝে গেলো জীবনের বাস্তবতা। প্রতি সপ্তাহে আমার ওষুধ খরচ,আনুসাঙ্গিক খরচ সব এখন তার মাথার উপর। নিজেকে খুব অপরাধী লাগে। সুখে রাখার কথা দিয়ে যাকে আমার করে নিয়েছিলাম, আজ সে আমাকে সুখ দিয়ে যাচ্ছে। সর্বোচ্চ সুখী রাখার চেষ্টা করছে।

মাঝে মাঝে মেয়েটা অবুঝ হয়ে যায়।আমাকে হুট করে বলে উঠে,"আচ্ছা,সত্যিই কি তুমি আর ভালো হতে পারবে না? আমি কি আর পারবোনা তোমার হাত ধরে খালি পায়ে ঘাসের উপর হাটতে?" আমার একটা দীর্ঘশ্বাস তার উত্তর দিয়ে দিয়ে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে একটা হাসি দেয়। চিৎকার করে বলে,"তাতে কি? হয়তো ঘাসের উপর তোমার সাথে হাটলে শামুকে পা পড়তো আমার, রক্ত ঝরতো। তোমার কি সহ্য হতো বলো?" আমি বলি,"একটুও না! "

সে হেসে দেয়। বলে,"দেখেছ আমি কত্ত সুখে আছি! আমি সারাদিন তোমার মাথায় হাত বুলাতে পারি। সারাদিনই তোমার হাত ধরে রাখতে পারি। আমার পা শামুকে কাটে না।" আমি বুঝতে পারি সে সুখ খুজে নেয়ার চেষ্টা করছে।

রাতে আমাদের দুজনকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি জেগে থাকে। পরের দিনের কাজ গুছিয়ে রাখে। অনেক রাতে যখন আমি নাক ডেকে ঘুমানো শুরু করি তখন সে ঘুমোতে যায় মাত্র! কখন উঠে যায় আবার আমি বুঝতে পারিনা।

মাঝে মাঝে ওকে আমি স্যরি বলি। আমি কেদে দিই ওর হাত ধরে। আমি ওকে কিছু দিতে পারিনি। ও তখন আমাদের পুতুলের মতো মেয়েটার চুলে হাত বোলায়। কাপা গলায় বলে,"এই যে দিয়েছো। আমার আরেকটা জীবন! "

ওর সুখের পরিধিটা এখন ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু ও এই পরিধির মাঝেই ভালো থাকার চেষ্টা করে। চেষ্টা করে ওর মাঝেই আরো দুটো জীবনকে সুখে রাখার। কে জানে,সে আসলে কট্টুক সুখ পাচ্ছে...

লেখক : আলেকজেন্ডার আবীর

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ei Golpo Gulo Pore Bastob Jibone Keo Practice Korte Jaben Na, Moja Nin Sudhu"
Ja khusi likhun,kintu lekhok ke ukti kore kono karap comment korben na,eta sob patoker kache onurodh,kono other site link post korben na,tahole coment publish kora hobe na...................