ভালবাসা জিনিষটা কী জানেনা ফাল্গুনী। সে শুধু জানে মৃন্ময় নামের ছেলেটাকে সে ভালবাসে। যে টান মৃন্ময়ের কথা তাকে ভাবায়, মুগ্ধ করে রাখে, আচ্ছন্ন করে রাখে সারাক্ষন, কারণে অকারণে মৃন্ময় এর ছবি ভাসিয়ে তুলে চোখের তারায়, সে টান টাই হয়তো ভালবাসা। এত টুকু জানলেই চলতো তার। তবে ফাল্গুনী আরও জানে।
সে জানে মৃন্ময়কে সে ভালবাসে, আর মৃন্ময় নামের ছেলেটাও তাকে প্রচণ্ড ভালবাসে। এইত সকল জানা, সকল পাওয়া এই জানার মাঝেই। পৃথিবীর সবগুলো প্রশ্ন, সবগুলো অভিমান, সবগুলো চোখের পানি, সবকটা স্বপ্নের উত্তর আর সব সমস্যার সহজ সমাধান একটা কথাই, ভালবাসার মানুষের কাছ থেকে ভালবাসি কথাটা শোনা।
আজ ঠিক ২১ দিন পর ফাল্গুনী সাথে দেখা হচ্ছে মৃন্ময়ের। ফাল্গুনী সবসময় সাধারণ থাকতে পছন্দ করে। সাজুগুজু জিনিষটা খুব একটা পছন্দ না তার। শুধুমাত্র সাজুগুজু করাকেই সৌন্দর্য বলেনা। সৌন্দর্য এমন একটা ব্যপার যা মন থেকে আসে। আর সবার ভেতরেই সৌন্দর্যটা আগে থেকেই দিয়ে দেয়া। সেটাকে বের করতে সাজুগুজু করতে হয় না।
তবে ফাল্গুনী আজ আয়নার সামনে বসে আছে। সে আজ সাজুগুজু করবে। হালকা সাজল সে। এতদিন পর দেখা বলে কথা। সবাই একটু এলোমেলো হয়ে যায় এই সময়ে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিতে যাবে এই সময়ে হাত থেকে লিপস্টিক পড়ে গেল তার। ফাল্গুনী কুসংস্কারে বিশ্বাসী নয়, তাও কি মনে করে যেন আর লিপস্টিক দিলো না ঠোঁটে। জামা, ওড়না, ব্যগ সবকিছুই ঠিকঠাক ফাল্গুনীর। একদম তৈরি সে। কিন্তু সমস্যাটা পায়ে। পায়ে তার স্পঞ্জ। বাসায় পরার স্পঞ্জ। স্যান্ডেলটা রাতে ছিঁড়ে গিয়েছিলো হালকা। সে মুচির কাছে রেখে এসেছে সেলাই করে দেবার জন্য। রাতে দেরি হয়ে যাওয়ায় আনেনি। তবে সমস্যা নেই, রাস্তাটা ওদিকেই। যাবার সময় স্পঞ্জ টা রেখে জুতোটা নিয়ে যাবে।
ফাল্গুনী হেটে যাচ্ছে। মনে অনেক আনন্দ। সে ভাবছে, ইসশ! ছেলে হলে গলা ছেড়ে একটু গান গাওয়া যেতো। মেয়ে হলেও গাওয়া যায়, কেউ কিছু বলবেনা। তবে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকবে। এত বড় একটা মেয়ে রাস্তায় জোরে গান গেয়ে যাচ্ছে, চোখ বড় করারই করার কথা। এসব ভেবে হাসছে সে, তবে শুধু যে এই কারণে হাসছে এমনটা না।
তার মুখে হাসি লেগেই আছে, আর চোখে কিছু দুষ্টু দুষ্টু চাহুনি। কেউ যখন বেশি খুশি থাকে তখন সে অট্টহাসি হাসে না, ঠোঁটের কোণে একটা হাসি লেগেই থাকে, থামে না। হাসতে হাসতে মানুষটার গাল দুটোতে ব্যথা হয়ে যায়, তবু ও হাসি থামে না। থামাতে চাইলে ও থামানো যায়না। ফাল্গুনীরও এখন এই অবস্থা, সেও এরকম হাসছে। হাসবেই বা না কেন? আজ যে সে অনেকদিন পর দেখা পাবে তার স্বপ্নবালকের।
২
হঠাৎ করেই ফাল্গুনীর মুখটা কালো হয়ে গেলো। মুচি ছেলেটার বসার জায়গা খালি। ছেলেটা এখনও আসেনি। মুচি ছেলেটা নেই, জুতো এখন না নেয়া গেলেও পরে নেয়া যাবে। কিন্তু মৃন্ময় এর সাথে দেখা করার কি হবে! এভাবে স্পঞ্জ পায়ে ভালবাসার মানুষের সাথে দেখা করতে যাওয়াটা কেমন যেন দেখায়! যদিও মৃন্ময় কিছুই বলবেনা, আর এটি বলার মত কোন বিষয়ও না। তবুও কেমন একটা খারাপ লাগা ভাব থেকেই যায় নিজের মাঝে! এতদিন পর দেখা হচ্ছে, সেই দিন ই যদি সে স্পঞ্জ পড়ে যায়, ব্যপারটা অবশ্যই ভাল দেখায় না!
চোখে মুখে চিন্তার রেখা ফোটে উঠেছে ফাল্গুনীর। একরকম অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে তার। এই সময় হঠাৎ করে ছেলেটাকে হন্তদন্ত হয়ে ছোটে আসতে দেখা গেলো। আসতেই ছেলেটাকে ধমক লাগালো ফাল্গুনী। হালকা ধমক দেবার পর ছেলেটার কাচুমুচু চেহারা দেখে সে আর কিছু বললনা, জুতোটা দিতে বলল তাড়াতাড়ি। ছেলেটা কিছু না বলে তার জায়গায় বসলো, কপালের ঘাম এক হাত দিয়ে মুছে নিল। ফাল্গুনীর দিকে হালকা একটা করুণ চাহুনি দিলো। তারপর বলতে শুরু করলো “আফা! কাইল রাইতে আফনের জুতা নিয়া বাড়িত চইলা গেসিলাম, হেরপর ছাইড্ডা খাইয়াই আফনের জুতা সিলাইছি আফা! সিলাই দিয়া আমার বাক্সের কাছে রাইখা ঘুমাইয়া গেলাম । অহন সকালে উইট্টা দেহি আফা, আফনের জুতা জোড়া নাই। বিশ্বাস করেন আফা! হারা বস্তি খুইজা আফনের জুতা পাই নাই আফা! অহন আমি কি করুম আফা আফনেই কন, আফনের জুতা খুঁজতে গিয়াই দেরি হইলো, কিন্তু পাইলাম না আফা!”
এই বলেই ছেলেটা হাউমাউ করে কান্না আরম্ভ করলো ... এমনিতেই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে ফাল্গুনীর। তার উপর এইসব ন্যকা কান্না তার একদম পছন্দ না। ওদিকে মৃন্ময় এর সাথে দেখা করার সময় ও হয়ে গেলো। সাথে বেশী টাকা ও নেই যে আরেকটা জুতো কিনবে। এইদিকে ছেলেটাকে ও কি বলবে বুঝতে পারছে না ফাল্গুনী। ছেলেটা আবার বলল “আফা! বিশ্বাস করেন আফা! আমি সত্যিই আফনের জুতা সিলাইছিলাম। সেই সকাল থাইক্কা খুইজা খুইজা পাই নাই আফা! কি করুম অহন? সব দোষ আমার”।
এই বলেই ছেলেটা কান্নার শব্দ আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। ফাল্গুনী এখন চাইলেই ছেলেটার কালো চকচকে গালে কষে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিতে পারে। ছেলেটা যে অপরাধ করেছে, এতে থাপ্পড় দেয়াই যায়। কিন্তু এভাবে কাউকে থাপ্পড় দেবার পুর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ফাল্গুনী দিতে পারছে না। একটা জড়তা কাজ করছে তার মাঝে। ফাল্গুনী দিলো এক ধমক, “এই ব্যটা, জুতোর কি পাখা গজাইছে নাকি যে নিজে থেকে উড়াল দেবে ? চোরের ব্যটা চোর!” এইটুকু বলেই সে বুঝতে পারলো থাপ্পড় টা সে দিতে পারবে। জীবনের প্রথম থাপ্পড় একটা কালো চকচকে গালে বসিয়েই দিলো ফাল্গুনী। ছেলেটার দিকে আরেকবার তাকাল ফাল্গুনী। চোখে পানি, আর কপালের কয়েকটা ভাঁজে ভাঁজে ঘাম এর ফোঁটা চিক চিক করছে। ফাল্গুনী আর কিছু না বলে ঘুরে হাটা শুরু করলো। মুচি ছেলেটা গালে হাত দিয়ে আপনমনে হাসছে। সেইসাথে চোখে দুফোঁটা জল, সূর্যের হালকা আলো এসেছে পড়েছে তাতে। সেই চোখের জলের ফোঁটায় ভাসছে আগের রাতের কাহিনী ।
৩
রইছ, বাবা রইছ, খানি লইছি, খাইবি আয়। মায়ের ডাকে জুতোর সেলাই তাড়াতাড়ি সেরে ফেলল রইছ। একজন আপু তাকে জুতোটা সেলাই করে রাখতে বলেছে। কাল সকাল সকাল নেবে। সে ও সেলাই করে ফেলেছে। হাত ধুয়ে খেতে বসলো সে। খাওয়া শেষ করে দেখল ওই আপুর জুতো টা তার মা পায়ে দিয়ে আছে। মায়ের পায়ে জুতোটা মানিয়েছে ও বেশ!
মা বলছে “এইডার মতন একখান জুতা আনিছ তো আমার লাইগা বাপ, ছোডবেলায় আব্বা আইনা দিত লাল লাল জুতা। আমার যা ভালা লাগতো! লাল জুতা পায়ে লাগাইতাম, আর হারা গেরাম ঘুইরা বেড়াইয়া মাইনষেরে আমার নতুন জুতা দেহাইতাম। অহন তো আর অইসব বয়স ও নাইরে বাপ! তা ও মাযে মাযে শখ হয় আর কি! কম দামে পাইলে আনিছ তো একখান! এইটুকু বলেই রইছের মা জুতো খুলতে যাচ্ছিলেন। রইছ বাঁধা দিলো। আরে মা! খুলো ক্যান? তোমার আব্বা অহন আমি না?
আমি তোমার লাইগাই এই জুতা আনছি। এক দোকানে কম দামের পাইয়া নিয়া আইছি। একটুখানি সিলাই করন লাগছে, এই আর কি! এইডা তোমার লাইগাই। পায়ে দিয়া রাখো। রইছের মা মমতা মাখা এক চিলতে হাসির সাথে রইছ কে বুকে জড়িয়ে নিলেন। উনি ছেলের উপর খুব খুশি। আবেগ মাখা হাসিতে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। রইছ মায়ের বুকে মুখ লুকালো, সাথে সত্যটা ও লুকিয়ে ফেললো। রাত বাড়ছে। বাঁপাশের খোলা জানালা দিয়ে একফালি আলো এসে পড়ছে মা ছেলের মুখে। সে আলোয় রইস বা তার মা কারো চোখের জলই কেউ দেখতে পাচ্ছে না। অনেকদিন পর আজ মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়েছে রইস। রইসের মায়ের খাওয়া হয়নি। পানি দেয়া ভাত আর পুঁইশাক ঢাকা দেয়া আছে। খিদা লাগলেও রইসের মাথা সরিয়ে উঠে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছেনা তার। দুজনের চোখেই টলটল করছে সুখের জল। শুধু জানালা দিয়ে একা চাঁদটাই মাঝেমাঝে উঁকি দিয়ে মনভরে দেখছে যেন মা ছেলের এই অব্যক্ত ভালবাসা ।
লেখক- চৌধুরী আদি
সে জানে মৃন্ময়কে সে ভালবাসে, আর মৃন্ময় নামের ছেলেটাও তাকে প্রচণ্ড ভালবাসে। এইত সকল জানা, সকল পাওয়া এই জানার মাঝেই। পৃথিবীর সবগুলো প্রশ্ন, সবগুলো অভিমান, সবগুলো চোখের পানি, সবকটা স্বপ্নের উত্তর আর সব সমস্যার সহজ সমাধান একটা কথাই, ভালবাসার মানুষের কাছ থেকে ভালবাসি কথাটা শোনা।
আজ ঠিক ২১ দিন পর ফাল্গুনী সাথে দেখা হচ্ছে মৃন্ময়ের। ফাল্গুনী সবসময় সাধারণ থাকতে পছন্দ করে। সাজুগুজু জিনিষটা খুব একটা পছন্দ না তার। শুধুমাত্র সাজুগুজু করাকেই সৌন্দর্য বলেনা। সৌন্দর্য এমন একটা ব্যপার যা মন থেকে আসে। আর সবার ভেতরেই সৌন্দর্যটা আগে থেকেই দিয়ে দেয়া। সেটাকে বের করতে সাজুগুজু করতে হয় না।
তবে ফাল্গুনী আজ আয়নার সামনে বসে আছে। সে আজ সাজুগুজু করবে। হালকা সাজল সে। এতদিন পর দেখা বলে কথা। সবাই একটু এলোমেলো হয়ে যায় এই সময়ে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিতে যাবে এই সময়ে হাত থেকে লিপস্টিক পড়ে গেল তার। ফাল্গুনী কুসংস্কারে বিশ্বাসী নয়, তাও কি মনে করে যেন আর লিপস্টিক দিলো না ঠোঁটে। জামা, ওড়না, ব্যগ সবকিছুই ঠিকঠাক ফাল্গুনীর। একদম তৈরি সে। কিন্তু সমস্যাটা পায়ে। পায়ে তার স্পঞ্জ। বাসায় পরার স্পঞ্জ। স্যান্ডেলটা রাতে ছিঁড়ে গিয়েছিলো হালকা। সে মুচির কাছে রেখে এসেছে সেলাই করে দেবার জন্য। রাতে দেরি হয়ে যাওয়ায় আনেনি। তবে সমস্যা নেই, রাস্তাটা ওদিকেই। যাবার সময় স্পঞ্জ টা রেখে জুতোটা নিয়ে যাবে।
ফাল্গুনী হেটে যাচ্ছে। মনে অনেক আনন্দ। সে ভাবছে, ইসশ! ছেলে হলে গলা ছেড়ে একটু গান গাওয়া যেতো। মেয়ে হলেও গাওয়া যায়, কেউ কিছু বলবেনা। তবে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকবে। এত বড় একটা মেয়ে রাস্তায় জোরে গান গেয়ে যাচ্ছে, চোখ বড় করারই করার কথা। এসব ভেবে হাসছে সে, তবে শুধু যে এই কারণে হাসছে এমনটা না।
তার মুখে হাসি লেগেই আছে, আর চোখে কিছু দুষ্টু দুষ্টু চাহুনি। কেউ যখন বেশি খুশি থাকে তখন সে অট্টহাসি হাসে না, ঠোঁটের কোণে একটা হাসি লেগেই থাকে, থামে না। হাসতে হাসতে মানুষটার গাল দুটোতে ব্যথা হয়ে যায়, তবু ও হাসি থামে না। থামাতে চাইলে ও থামানো যায়না। ফাল্গুনীরও এখন এই অবস্থা, সেও এরকম হাসছে। হাসবেই বা না কেন? আজ যে সে অনেকদিন পর দেখা পাবে তার স্বপ্নবালকের।
২
হঠাৎ করেই ফাল্গুনীর মুখটা কালো হয়ে গেলো। মুচি ছেলেটার বসার জায়গা খালি। ছেলেটা এখনও আসেনি। মুচি ছেলেটা নেই, জুতো এখন না নেয়া গেলেও পরে নেয়া যাবে। কিন্তু মৃন্ময় এর সাথে দেখা করার কি হবে! এভাবে স্পঞ্জ পায়ে ভালবাসার মানুষের সাথে দেখা করতে যাওয়াটা কেমন যেন দেখায়! যদিও মৃন্ময় কিছুই বলবেনা, আর এটি বলার মত কোন বিষয়ও না। তবুও কেমন একটা খারাপ লাগা ভাব থেকেই যায় নিজের মাঝে! এতদিন পর দেখা হচ্ছে, সেই দিন ই যদি সে স্পঞ্জ পড়ে যায়, ব্যপারটা অবশ্যই ভাল দেখায় না!
চোখে মুখে চিন্তার রেখা ফোটে উঠেছে ফাল্গুনীর। একরকম অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে তার। এই সময় হঠাৎ করে ছেলেটাকে হন্তদন্ত হয়ে ছোটে আসতে দেখা গেলো। আসতেই ছেলেটাকে ধমক লাগালো ফাল্গুনী। হালকা ধমক দেবার পর ছেলেটার কাচুমুচু চেহারা দেখে সে আর কিছু বললনা, জুতোটা দিতে বলল তাড়াতাড়ি। ছেলেটা কিছু না বলে তার জায়গায় বসলো, কপালের ঘাম এক হাত দিয়ে মুছে নিল। ফাল্গুনীর দিকে হালকা একটা করুণ চাহুনি দিলো। তারপর বলতে শুরু করলো “আফা! কাইল রাইতে আফনের জুতা নিয়া বাড়িত চইলা গেসিলাম, হেরপর ছাইড্ডা খাইয়াই আফনের জুতা সিলাইছি আফা! সিলাই দিয়া আমার বাক্সের কাছে রাইখা ঘুমাইয়া গেলাম । অহন সকালে উইট্টা দেহি আফা, আফনের জুতা জোড়া নাই। বিশ্বাস করেন আফা! হারা বস্তি খুইজা আফনের জুতা পাই নাই আফা! অহন আমি কি করুম আফা আফনেই কন, আফনের জুতা খুঁজতে গিয়াই দেরি হইলো, কিন্তু পাইলাম না আফা!”
এই বলেই ছেলেটা হাউমাউ করে কান্না আরম্ভ করলো ... এমনিতেই রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে ফাল্গুনীর। তার উপর এইসব ন্যকা কান্না তার একদম পছন্দ না। ওদিকে মৃন্ময় এর সাথে দেখা করার সময় ও হয়ে গেলো। সাথে বেশী টাকা ও নেই যে আরেকটা জুতো কিনবে। এইদিকে ছেলেটাকে ও কি বলবে বুঝতে পারছে না ফাল্গুনী। ছেলেটা আবার বলল “আফা! বিশ্বাস করেন আফা! আমি সত্যিই আফনের জুতা সিলাইছিলাম। সেই সকাল থাইক্কা খুইজা খুইজা পাই নাই আফা! কি করুম অহন? সব দোষ আমার”।
এই বলেই ছেলেটা কান্নার শব্দ আরেকটু বাড়িয়ে দিলো। ফাল্গুনী এখন চাইলেই ছেলেটার কালো চকচকে গালে কষে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিতে পারে। ছেলেটা যে অপরাধ করেছে, এতে থাপ্পড় দেয়াই যায়। কিন্তু এভাবে কাউকে থাপ্পড় দেবার পুর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ফাল্গুনী দিতে পারছে না। একটা জড়তা কাজ করছে তার মাঝে। ফাল্গুনী দিলো এক ধমক, “এই ব্যটা, জুতোর কি পাখা গজাইছে নাকি যে নিজে থেকে উড়াল দেবে ? চোরের ব্যটা চোর!” এইটুকু বলেই সে বুঝতে পারলো থাপ্পড় টা সে দিতে পারবে। জীবনের প্রথম থাপ্পড় একটা কালো চকচকে গালে বসিয়েই দিলো ফাল্গুনী। ছেলেটার দিকে আরেকবার তাকাল ফাল্গুনী। চোখে পানি, আর কপালের কয়েকটা ভাঁজে ভাঁজে ঘাম এর ফোঁটা চিক চিক করছে। ফাল্গুনী আর কিছু না বলে ঘুরে হাটা শুরু করলো। মুচি ছেলেটা গালে হাত দিয়ে আপনমনে হাসছে। সেইসাথে চোখে দুফোঁটা জল, সূর্যের হালকা আলো এসেছে পড়েছে তাতে। সেই চোখের জলের ফোঁটায় ভাসছে আগের রাতের কাহিনী ।
৩
রইছ, বাবা রইছ, খানি লইছি, খাইবি আয়। মায়ের ডাকে জুতোর সেলাই তাড়াতাড়ি সেরে ফেলল রইছ। একজন আপু তাকে জুতোটা সেলাই করে রাখতে বলেছে। কাল সকাল সকাল নেবে। সে ও সেলাই করে ফেলেছে। হাত ধুয়ে খেতে বসলো সে। খাওয়া শেষ করে দেখল ওই আপুর জুতো টা তার মা পায়ে দিয়ে আছে। মায়ের পায়ে জুতোটা মানিয়েছে ও বেশ!
মা বলছে “এইডার মতন একখান জুতা আনিছ তো আমার লাইগা বাপ, ছোডবেলায় আব্বা আইনা দিত লাল লাল জুতা। আমার যা ভালা লাগতো! লাল জুতা পায়ে লাগাইতাম, আর হারা গেরাম ঘুইরা বেড়াইয়া মাইনষেরে আমার নতুন জুতা দেহাইতাম। অহন তো আর অইসব বয়স ও নাইরে বাপ! তা ও মাযে মাযে শখ হয় আর কি! কম দামে পাইলে আনিছ তো একখান! এইটুকু বলেই রইছের মা জুতো খুলতে যাচ্ছিলেন। রইছ বাঁধা দিলো। আরে মা! খুলো ক্যান? তোমার আব্বা অহন আমি না?
আমি তোমার লাইগাই এই জুতা আনছি। এক দোকানে কম দামের পাইয়া নিয়া আইছি। একটুখানি সিলাই করন লাগছে, এই আর কি! এইডা তোমার লাইগাই। পায়ে দিয়া রাখো। রইছের মা মমতা মাখা এক চিলতে হাসির সাথে রইছ কে বুকে জড়িয়ে নিলেন। উনি ছেলের উপর খুব খুশি। আবেগ মাখা হাসিতে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। রইছ মায়ের বুকে মুখ লুকালো, সাথে সত্যটা ও লুকিয়ে ফেললো। রাত বাড়ছে। বাঁপাশের খোলা জানালা দিয়ে একফালি আলো এসে পড়ছে মা ছেলের মুখে। সে আলোয় রইস বা তার মা কারো চোখের জলই কেউ দেখতে পাচ্ছে না। অনেকদিন পর আজ মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়েছে রইস। রইসের মায়ের খাওয়া হয়নি। পানি দেয়া ভাত আর পুঁইশাক ঢাকা দেয়া আছে। খিদা লাগলেও রইসের মাথা সরিয়ে উঠে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছেনা তার। দুজনের চোখেই টলটল করছে সুখের জল। শুধু জানালা দিয়ে একা চাঁদটাই মাঝেমাঝে উঁকি দিয়ে মনভরে দেখছে যেন মা ছেলের এই অব্যক্ত ভালবাসা ।
লেখক- চৌধুরী আদি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Ei Golpo Gulo Pore Bastob Jibone Keo Practice Korte Jaben Na, Moja Nin Sudhu"
Ja khusi likhun,kintu lekhok ke ukti kore kono karap comment korben na,eta sob patoker kache onurodh,kono other site link post korben na,tahole coment publish kora hobe na...................